বন্য প্রাণী রক্ষায় কমছে ট্রেনের গতি

উদ্যান এলাকায় ট্রেনের গতিসীমা ২০ কিলোমিটারে রাখতে চেষ্টা চলছে। সর্বশেষ রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে রেলওয়েকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরে রয়েছে রেললাইন। সেখানে প্রাণীদের নিরাপদে চলাচলের জন্য তৈরি করা হয়েছে বনসেতু
ফাইল ছবি

মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে যাওয়া ঢাকা-সিলেট রেলপথটি সেখানকার বন্য প্রাণী চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিবছরই দ্রুত গতির ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা যাচ্ছে অনেক প্রাণী। কোনোভাবেই বন্য প্রাণীর মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।

বনের ভেতর থেকে রেলপথ সরানো একটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। এমন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বিকল্প রেলপথ তৈরির আগপর্যন্ত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এলাকায় ট্রেনের গতিসীমা ২০ কিলোমিটারে নিয়ন্ত্রিত রাখতে অনেক দিন ধরে চেষ্টা চলছে। বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ থেকে গতিসীমা কমানোর জন্য এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষককে একটি চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বুক চিরে যাওয়া রেলপথে বিকট শব্দে দ্রুত গতির ট্রেন চলায় বন্য প্রাণীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, প্রজনন ও চলাচল মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। বন্য প্রাণীর চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ট্রেন লাইনে সর্বোচ্চ গতি বর্তমান অবস্থা থেকে হ্রাস করে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটারের মধ্যে রাখা দরকার।

একই প্রস্তাবের ধারাবাহিকতায় একই কর্মকর্তা (বিভাগীয় বন কর্মকর্তা) গত বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষককে আরেকটি চিঠি দেন। সেই চিঠিতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অভ্যন্তরে ট্রেনের গতি কমানোর যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। চিঠিতে ভারতের রাজাজি ন্যাশনাল পার্কের অভ্যন্তর দিয়ে ট্রেন চলাচল নিয়ে তাঁর কিছু অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হয়।

চিঠিতে রেজাউল করিম লেখেন, ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার দেরাদুনে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনার ওপর পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্সে প্রশিক্ষণের সময় কোর্সের অংশ হিসেবে তিনি রাজাজি ন্যাশনাল পার্ক পরিদর্শন করেন। সেই অভিজ্ঞতাও চিঠিতে তুলে ধরেন রেজাউল।

চিঠিতে বলা হয়, দেরাদুন থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান হরিদুয়ার-ঋষিকেশ যাওয়ার পথে রাজাজি ন্যাশনাল পার্কের অভ্যন্তরে রেললাইনে ট্রেনের গতিসীমা সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার রাখা হয়েছে। ন্যাশনাল পার্কের হাতি, বাঘ, হনুমান, বানর, হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণীর জীবন রক্ষার্থে যাত্রীবাহী ট্রেন ২০ কিলোমিটার গতিতে চলেছে। হাতি ও বাঘের সঙ্গে কোনো প্রকার সংঘর্ষ এড়াতে ট্রেনচালকেরাও খুবই সচেতন। এই ন্যাশনাল পার্কের অভ্যন্তরে বন্য প্রাণীর নিশ্চিত মৃত্যু ঠেকিয়ে ট্রেনচালক ও পরিচালক ভারতে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও পেয়েছেন। জাতীয় স্বার্থে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অভ্যন্তরে ট্রেনের গতি হ্রাস করে ভারতের মতো ঘণ্টায় ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয় চিঠিতে।

এদিকে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে গত ২৫ জানুয়ারি রেলপথ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯ জানুয়ারি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. তৌফিক ইমাম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালককে দেওয়া হয়েছে। এই চিঠিতে বলা হয়েছে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে রেললাইনে বন্য প্রাণীর মৃত্যু রোধ ও এদের জীবনযাত্রা নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে বিদ্যমান রেলওয়ে দিয়ে চলাচলকারী সব ট্রেনের গতিসীমা ২০ কিলোমিটারের মধ্যে রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হলো।

বন বিভাগ ও স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, সরকার ১৯৯৬ সালে লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে। ১ হাজার ২৫০ হেক্টরের চিরহরিৎ ও মিশ্র চিরহরিৎ এই বনে উল্লুক, বানর, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, বনমোরগ, বনরুই, মায়া হরিণ, মেছো বাঘ, বন্য শূকর, অজগরসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী আছে। লাউয়াছড়া উদ্যানে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৫৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ২২ প্রজাতির উভচরসহ অসংখ্য বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির আবাসস্থল এবং প্রজননক্ষেত্র। প্রতিবছর সড়ক ও রেলপথে লাউয়াছড়ার অর্ধশতাধিক বন্য প্রাণীর মৃত্যু ঘটছে।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, লাউয়াছড়ার অভ্যন্তরে ট্রেনের গতিসীমা কমানো খুবই দরকার। প্রতিবছর দেখা যায় সাত-আটটি বড় প্রাণী ট্রেনে কাটা পড়ছে। বনের ভেতর মাত্র সাড়ে সাত কিলোমিটার জায়গা। কিন্তু ট্রেন এত দ্রুত যায়, বন প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। মানুষও দুর্ঘটনাকবলিত হয়। ট্রেনের গতি কমানোর বিষয়টি রেলপথ মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে বিবেচনাধীন আছে। সিদ্ধান্তটি অনুমোদন পেলে বিরল প্রাণীগুলো বেঁচে যাবে।