ঐতিহ্য নিয়ে টিকে আছে বগুড়ার শতবর্ষী অন্নপূর্ণা হোটেল
বগুড়া শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়কের প্রজাবাহিনী প্রেস দাস লেনে সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘অন্নপূর্ণা হোটেল ও আবাসিক বোর্ডিং’। এটি শুধু একটি দোতলা পুরোনো ভবন নয়, একসময়ের বগুড়ার সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও মুক্তচিন্তার মানুষের আনাগোনার কেন্দ্রবিন্দু; কবি-সাহিত্যিকদের আঁতুড়ঘর।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের আড্ডাস্থল হয়ে উঠেছিল অন্নপূর্ণা। নানা ঘটনার সাক্ষী শতবর্ষী এই অন্নপূর্ণা জৌলুশ হারালেও এখনো ঐতিহ্য ধরে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
শতবর্ষ পেরিয়ে
এখন যেখানে কোয়ালিটি সুইটসের অবস্থান, প্রাচীন বাংলার রাজধানী পুণ্ড্রবর্ধনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বগুড়া শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়কে গত শতাব্দীর প্রথম দিকে বৈষ্ণব দাশ পান্ডে নামে একজন ব্যবসায়ী চালু করেন অন্নপূর্ণা হিন্দু হোটেল ও বোর্ডিং। খাবারের পাশাপাশি শুরু থেকেই আগন্তুকদের রাতযাপনের ব্যবস্থা ছিল এখানে। বংশপরম্পরায় এটি পরে পরিচালনা করেন বৈষ্ণব দাশ পান্ডের ছেলে নীলমণি দাশ পান্ডেসহ তাঁর উত্তরসূরিরা। দেশভাগের আগেই ১৯৪৫ সালের ২১ নভেম্বর ব্রিটিশ সরকারের তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট অন্নপূর্ণা হোটেলের লাইসেন্স দেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা–পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত এর মালিকানা ছিল বিমল আচার্য ঠাকুরের।
স্বাধীনতার পর অন্নপূর্ণার মালিকানা কিনে নেন শিবগঞ্জ উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের কুকি জগন্নাথপুর গ্রামের স্কুলশিক্ষক নৃপেন্দ্রনাথ দাশ। বাবার সঙ্গে ব্যবসা দেখভাল করতেন ছেলে চন্দন কুমার দাশ। বাবার পরলোকগমনের পর থেকে চন্দন কুমার দাশই অন্নপূর্ণা পরিচালনা করছেন। তাঁকে বসায় সহযোগিতা করছেন তাঁর স্ত্রী অঞ্জলী রানী দাশ।
চন্দন কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর ক্রয়সূত্রে অন্নপূর্ণার মালিকানা পান বাবা নৃপেন্দ্রনাথ দাশ। ১০ বছর বয়স থেকে বাবার ব্যবসা দেখভাল করে আসছিলাম। অন্নপূর্ণা নামের সঙ্গে শতবছরের ঐতিহ্য জড়িয়ে থাকায় হাতবদলের পরও আর নাম পরিবর্তন হয়নি। হোটেলটির লাইসেন্সও অন্নপূর্ণা হোটেল নামে। প্রথম দিকে এটি ছিল খাবারের হোটেল। পরে আবাসিক বোর্ডিং যুক্ত হয়। স্বাধীনতা–পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ে খুব দ্রুতই এর পরিধি ছড়িয়ে পড়ে বগুড়ার সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে।
কে এই বৈষ্ণব দাশ পান্ডে
অন্নপূর্ণা হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা বৈষ্ণব দাশ পান্ডে ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি ভারতের উড়িষ্যা থেকে এসে বগুড়ায় ব্যবসা করতেন। ভোজনরসিক মানুষ বিশেষ করে অফিসের কাজে কিংবা বাজার-সওদা করতে বগুড়ায় এলে থাকা ও খাওয়ার সমস্যা হতো। তাঁদের সুবিধার্থে তিনি মূলত অন্নপূর্ণা হোটেল ও বোর্ডিং চালু করেন। খাবারের রেস্তোরাঁর পাশাপাশি আবাসিক সুবিধাও বিদ্যমান ছিল এখানে। শুরু থেকেই খাবারের হোটেল হিসেবে বেশ নামডাক ছিল অন্নপূর্ণার।
বর্তমান মালিক চন্দন কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, হিন্দুধর্মের দেবী অন্নপূর্ণার নামানুসারেই হোটেলের নাম অন্নপূর্ণা রাখা হয়েছিল। অন্নদাত্রী দেবী অন্নপূর্ণা দুর্গার আরেক রূপভেদ। বগুড়ার কবি ও প্রাবন্ধিক বজলুল করিম বাহার বলেন, পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিংয়ের মতোই অন্নপূর্ণা একসময় বগুড়ার সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের লোকজনের আড্ডাখানা ছিল। বিশেষ করে অন্নপূর্ণার পাশে‘প্রজাবাহিনী’ প্রেস ছিল কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডার ঠিকানা। নন্দিত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের বাবা ছিলেন ফয়জুর রহমান আহমেদ, আন্দামান নির্বাসিত ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের নেতা ডাক্তারদা আবদুল কাদের চৌধুরী, ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনসহ অনেকেই আড্ডা শেষে অন্নপূর্ণায় আহার সারতেন।
খাবারের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে অন্নপূর্ণা
নিরামিষ কিংবা মুড়িঘন্টের ঐতিহ্যের বাঙালি খাবারের কথা উঠলেই বগুড়ার অন্নপূর্ণার নাম আসে। আগের মতো কবি–সাহিত্যিকদের আড্ডা না থাকলেও এখনো ভোজনরসিকদের ভিড় থাকে। ঐতিহ্যকে ধারণ করে আজও এখানে স্টিলের থালায় ও গ্লাসে খাবার-পানি পরিবেশন করা হয়।
সম্প্রতি অন্নপূর্ণায় গিয়ে দেখা গেল, পুরোনো ইটের দোতলা ভবনের নিচতলায় খাবারের হোটেল। আর দোতলায় আবাসিক। খাবারের হোটেলে তিন বেলা হরেক বাঙালি খাবারের আয়োজন। স্টিলের থালায় খাবার পরিবেশনেও আছে বাঙালিয়ানার ছোঁয়া।
হোটেলের পুরোনো কর্মচারী প্রশান্ত সরকার প্রথম আলোকে বলেন, সকাল-দুপুর ও রাত। তিন বেলাতেই ভাত, ডাল, সবজি, নিরামিষ পাওয়া যায় এখানে। সঙ্গে খাসির মাংস, মুরগির মাংস, রুই, কাতলা, ইলিশ, বোয়াল, চিতল, কই মাছ, তেলাপিয়া, পাবদা, গচি মাছ, মাগুর, ছোট মাছ, খাসির কাটলেট, মুরগির লটপটি, কলিজা–সবজি, শাক, মুড়িঘন্ট, আলুভাজি, আলুভর্তা, বুটের ডাল, বেগুনভাজি, টাকি মাছ ভর্তা, কাঁচকলা ভর্তা, ভুনা খিচুড়ি, বিরিয়ানি, দই ও কোমল পানীয় পাওয়া যায়।
প্রশান্ত সরকার আরও বলেন, প্রতিদিন টাটকা বাজার করে রান্না হয় এখানে। প্রতি শুক্রবার আশপাশ ও দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন। পুরোনো আড্ডার আমেজটা পাওয়া যায়। প্রতিদিন এক মণ চালের ভাত রান্না করা হয়। প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ জন খাবার খেতে আসেন এখানে। বর্তমানে হোটেলে ১৩-১৪ জন কর্মচারী কাজ করেন। খাবার খেতে আসা ক্রেতা সেলিম হোসেন বলেন, খাবারের মূল্য কিছুটা বেশি মনে হলেও এখানকার শান্ত পরিবেশ এবং খাবার পরিবেশনে আতিথেয়তা প্রশংসার দাবিদার।
খাবার ঘরের দেয়ালে টাঙানো আছে কাঠে খোদাই করা পুরোনো মালিকের প্রতিকৃতিসহ কয়েকটি ছবি। ভোজনরসিকেরা মনে করেন, আড্ডা থাকুক আর না-ই থাকুক, তবু অন্নপূর্ণা বেঁচে থাকুক ঐতিহ্যের স্মারক আর কালের সাক্ষী হয়ে।
সংগ্রামে টিকে থাকা
জৌলুশ হারানো এক ঐতিহ্যের লড়াইয়ে এখনো টিকে আছে অন্নপূর্ণা হোটেল ও বোর্ডিং। এর দেখভালের দায়িত্বে থাকা চন্দন কুমার দাশ বলেন, এখন আর আগের মতো জৌলুশ নেই। পুরোনো এ ভবনে কেউ আসতে চায় না। ১৪টি কক্ষের আবাসিক বোর্ডিংয়ে থাকার মতো তেমন আগন্তুক মেলে না।