শ্যামনগর উপকূলে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে খাওয়ার পানির জন্য হাহাকার

নদী পার হয়ে সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য যাচ্ছেন তাঁরা। শনিবার শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের কালিঞ্চি এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে উপকূলীয় এলাকা সাতক্ষীরার শ্যামনগরে নিরাপদ খাওয়ার পানির সংকট আরও বেড়ে গেছে। চলতি মাসের শুরু থেকে এই সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানির জন্য চলছে হাহাকার। নারী-পুরুষ ও শিশুরা পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে মাইলের পর মাইল রাস্তা পাড়ি দিচ্ছেন। নিরাপদ পানি দুর্লভ হওয়ায় অনেকে পুকুরের কাদামিশ্রিত পানি পান করতেও বাধ্য হচ্ছেন।

শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ অঞ্চলে স্বাভাবিক অবস্থায় ৪০ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে থাকেন। তবে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে ৫০-৬০ শতাংশ মানুষের খাওয়ার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে পানিসংকট আরও বাড়তে পারে। উপজেলায় ১ হাজার ৯৪৯টি গভীর, ৪৯১টি অগভীর, ৫০০টি এসএসটি ও ৪৪১টি ভিএসএসটি নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে ৮টি গভীর, ১২৯টি অগভীর, ১৬টি এসএসটি ও ৪৪টি ভিএসএসটি নলকূপ কয়েক বছর ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে।

উপজেলায় জলবায়ু ও খাওয়ার পানির সংকট নিয়ে কাজ করে প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংগঠন। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক শম্পা গোস্বামী বলেন, শ্যামনগরের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে নির্ভর করতে হয় পুকুর ও বৃষ্টির পানির ওপর। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনিয়ন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, চিংড়িঘেরে উঁচু বাঁধ না দেওয়া, নদীপ্রবাহ আটকে দেওয়া, পুকুর ভরাট, খাল বেদখলের কারণে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের নিরাপদ পানির সংকটের মধ্যে দিয়ে দিন পার করতে হয়।

শম্পা গোস্বামী আরও বলেন, সাধারণত শীতের মৌসুম থেকে বর্ষা আসার আগপর্যন্ত লম্বা সময় এই দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাঁদের। কিন্তু চলতি মাসের শুরু থেকে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, কৈখালী, রমজাননগরসহ উপজেলার অধিকাংশ এলাকার প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা জলাধারগুলো চাহিদা পূরণে সক্ষম না হওয়ায় খাওয়ার পানির সংকট তীব্রতর হয়েছে। সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছেন নারীরা। এই গরমের মধ্যে তাঁরা কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েও চাহিদামতো পানি সংগ্রহ করতে পারছেন না।

দূর থেকে নিরাপদ পানি সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরছে দুই শিশু। শনিবার দুপুরে শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী বিজিপি ক্যাম্প এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

দুর্গাবাটি এলাকার গৃহবধূ সন্ধ্যা মণ্ডল। তিনি বলেন, খাওয়ার পানির সংকট সারা বছর ধরে থাকে তাঁদের। দুর্গাবাটি এলাকার পানির প্ল্যান্ট রয়েছে। তাঁরা সেখান থেকে প্রতি কলস পানি ১০ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে আসতেন। কিন্তু এখন প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে চাহিদামতো প্ল্যান্ট থেকে পানি উঠছে না।

শ্যামনগর সদরের চণ্ডীপুর গ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ডের পিএসএফ থেকে পানি নেওয়ার জন্য গতকাল শনিবার দুপুরে শতাধিক মানুষের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আয়ুব আলী ও সাবিনা খাতুন দম্পতি। তাঁরা জানালেন, আড়াই কিলোমিটার দূরে হাটছালা গ্রাম থেকে তাঁরা খাওয়ার পানি নিতে এসেছেন। বিদ্যুৎ না এলে পানি নিতে পারছেন না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পুকুরের তিন ভাগের দুই ভাগ শুকিয়ে গেছে, পানি ঘোলা। যা খাওয়ার অনুপযোগী।

শ্যামনগর উপজেলার খাগড়াদানা এলাকায় পিএসএফ থেকে নিরাপদ পানির জন্য অপেক্ষা গ্রামের নারীদের
ছবি: প্রথম আলো

কৈখালী ইউনিয়নের বৈশখালী এলাকার নুরুল হক গাজী বলেন, প্রচণ্ড দাবদাহে এলাকার অধিকাংশ পুকুরের পানি শুকিয়ে গেছে। অন্যদিকে নলকূপ দিয়ে পানি উঠছে না। সরকারি-বেসরকারি যেসব খাওয়ার পানির উৎস ছিল, সেগুলো সংস্কার না করায় সংকট বেড়েছে।

গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের আবদুল কাদের বলেন, এই এলাকার পানি লবণাক্ত। তাঁদের এলাকায় সরকারি কোনো পুকুর বা জলাধার না থাকায় প্রতিবছর দুই থেকে তিন মাস বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির কষ্টে কাটাতে হয় তাঁদের। কিন্তু চলতি মাসে দাবদাহে পানিসংকট তীব্র আকার ধারণ করায় তাঁদের কষ্ট বেড়েছে।

শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপে পানি কম উঠছে। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে পুকুর ও জলাধার শুকিয়ে গেছে। আরডব্লিউএইচ ও পিএসএফ ঠিকভাবে কাজ করছে না। ফলে পানির সংকট বেড়েছে। বৃষ্টি না হলে এই সংকট আরও বাড়তে পারে।