২০১৮ সালে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন মিঠুন আহমেদ। একজন নিকটাত্মীয়ের জন্য ১৩ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি ও অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করে সংগ্রহ করেন সেই রক্ত। তখন তিনি অনুভব করেন, চাহিদার তুলনায় নওগাঁ শহরে রক্তদাতার সংখ্যা কম। মানুষের জীবন বাঁচাতে অন্য তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে শুরু করেন রক্ত সংগ্রহের কাজ। গড়ে তোলেন অনলাইনভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন—‘মানবিক ব্লাড ফাউন্ডেশন’। 

নওগাঁতে বর্তমানে স্বেচ্ছায় রক্তদান সংগঠনের সংখ্যা বাড়ছে। আগে রোগী বা তাঁর স্বজনদের রক্তের জন্য অনেক ছোটাছুটি করতে হলেও এখন সহজে রক্ত জোগাড় করা যাচ্ছে। আর স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের বেশির ভাগ কলেজশিক্ষার্থী। তবে সমন্বয়হীনতার কারণে প্রয়োজনের সময় রক্ত দেওয়া সম্ভব হয় না বলে জানিয়েছেন রক্তদাতা সংগঠনগুলোর সমন্বয়কেরা।

২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠনের নিয়মিত রক্তদাতার সংখ্যা এক হাজারের ওপরে। মানবিক ব্লাড ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পেজের অ্যাডমিন মিঠুন আহমেদ নওগাঁ সরকারি কলেজে ব্যাচেলর অব বিজনেস স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

মিঠুন বলেন, ‘মানুষের জন্য রক্ত সংগ্রহের কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার জন্য অনেক মানুষের আগ্রহ আছে। কিন্তু সমন্বয়ের অভাবে প্রয়োজনের সময় রক্ত দেওয়া সম্ভব হয় না। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে আগ্রহী মানুষদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করি এবং খুব দ্রুত সমমনা কিছু শিক্ষার্থী নিয়ে গড়ে তুলি এ রক্তদানের সংগঠন।’ 

মিঠুন জানান, মানবিক ব্লাড ফাউন্ডেশনের নিয়মিত রক্তদাতা সদস্যের সংখ্যা এক হাজারের ওপরে। এসব সদস্যের অধিকাংশ নওগাঁ সরকারি কলেজ, নওগাঁ বিএমসি মহিলা কলেজ ও নওগাঁ আস্তান মোল্লা কলেজের বর্তমান শিক্ষার্থী। তাঁরা প্রতিদিন ১০-১২ ব্যাগ রক্ত দিয়ে থাকেন। এ পর্যন্ত মানবিক ব্লাড ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিনা মূল্যে তিন হাজার ব্যাগের বেশি রক্ত দেওয়া হয়েছে। সংগঠনটি বর্তমানে নওগাঁর ২০ জন থ্যালাসেমিয়া রোগীকে নিয়মিত রক্ত দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। সংগঠনের ফেসবুক পেজ কিংবা গ্রুপে রক্তের আহ্বানের পোস্ট করলে চাহিদা অনুযায়ী ওই গ্রুপের অ্যাডমিন রক্তদাতা সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর তাঁদের নির্দেশনা অনুযায়ী রক্তদাতা পৌঁছে যান রোগীর কাছে। 

মানবিক ব্লাড ফাউন্ডেশন ছাড়াও স্বেচ্ছায় রক্তদান করে, এমন আরও তিনটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সংগঠনগুলো হচ্ছে—নওগাঁ ব্লাড সার্কেল, রানীনগর ব্লাড ডোনার ক্লাব ও মহাদেবপুর ব্লাড ডোনেশন ক্লাব।

নওগাঁ ব্লাড সার্কেলের নির্বাহী পরিচালক সোয়াইব আহমেদ বলেন, ২০১৭ সালে আবু ইউসুফ নামের এক তরুণের নেতৃত্বে স্বেচ্ছায় রক্তদানের সংগঠন নওগাঁ ব্লাড সার্কেল গড়ে ওঠে। এ সংগঠনে বর্তমানে ৮০০–এর অধিক নিয়মিত রক্তদাতা রয়েছেন। নওগাঁ ব্লাড সার্কেল নামে তাঁদের ফেসবুক পেজ, মেসেঞ্জার গ্রুপ ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে। তাঁদের সংগঠন থেকে প্রতি মাসে ৬০ ব্যাগের বেশি রক্তদান করা হয়। বর্তমানে তাঁরা ১২ জন থ্যালাসেমিয়া রোগীর দায়িত্ব স্থায়ীভাবে নিয়েছেন। 

জন্মের পর থেকে থ্যালাসেমিয়া (রক্তশূন্যতা) রোগে ভুগছে নওগাঁ শহরের পারনওগাঁ এলাকার উত্তম কুমার মহন্তের ছেলে পিওম কুমার মহন্ত (৫)। পাঁচ বছর ধরে প্রতি মাসে তাকে এক ব্যাগ করে রক্ত দিতে হয়। উত্তম কুমার মহন্ত বলেন, ‘শুরুর দিকে রক্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে নানা জটিলতায় পড়তে হয়েছে। একদিন আমার পাড়ার ছেলে মিঠুন আহমেদ এ সমস্যার কথা শোনেন। আমার ছেলেকে তাঁদের সংগঠনের পক্ষ থেকে নিয়মিত রক্ত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তিন বছর ধরে মানবিক ব্লাড ফাউন্ডেশনের কলেজপড়ুয়া ছেলেরা আমার ছেলেকে রক্ত দিচ্ছেন। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।’

গত রোববার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়েছেন নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার জোয়ানপুর গ্রামের শেফালী উড়াও। অস্ত্রোপচারের কারণে তাঁর দুই ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। এবি নেগেটিভ গ্রুপ হওয়ায় তাঁর রক্ত মিলছিল না। শেষে মহাদেবপুর ব্লাড ডোনেশন ক্লাবের সন্ধান পান। ওই ক্লাবের সদস্য জাহিদ হোসেন ও বিপ্লব কুমার নামের দুই তরুণ শেফালীকে রক্ত দেন। 

শেফালীর স্বামী সুমন কুজর বলেন, ‘ম্যালা জন, ম্যালা জায়গায় রক্ত খুঁজিছি। কোথাও হামার বাড়িয়ালির (বউ) রক্ত পাছিলাম না। শেষে হামাগের গ্রামের এক মাস্টার এক দাদার নম্বর দিল। সেই দাদাক বলার পর দুই দাদাকে রক্ত দিতে পাঠায়। হামার বউ ও ছাওয়াল অ্যাখন ভালো আছে।’

নওগাঁর সিভিল সার্জন আবু হেনা মো. রায়হানুজ্জামান বলেন, রক্তদানের বেশ কিছু উপকারিতা আছে। এর মধ্যে প্রতি চার মাস অন্তর রক্ত দিলে দেহে নতুন ব্লাড সেল তৈরির প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া নিয়মিত রক্তদানকারীর হার্ট ও লিভার অন্য ব্যক্তিদের তুলনায় ভালো থাকে। রক্তদান অনেক ক্ষেত্রে ক্যানসারের ঝুঁকি কমায় এবং রক্তে কোলেস্টেরলের উপস্থিতি কমাতে সহায়তা করে।