এখন থেকে পাঁচ বছর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কেমন ছিল?
জামালউদ্দিন: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য হলো পরিযায়ী পাখি, গাছপালা ও কিছু জলাশয়। ক্যাম্পাসে ৩৫ বছরের মতো আমার বিচরণ। প্রথম দিকে সব জলাশয়ে পানি ছিল। এসব জলাশয়ে অজস্র পাখি থাকত। পাখিগুলো যখন ওড়া শুরু করত, তখন আকাশ কালো হয়ে যেত। কিন্তু সেটা এখন বিস্ময়কর মনে হতে পারে। পাঁচ বছর আগেও ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি বর্তমানের চেয়ে কিছুটা ভালো ছিল। কয়েক বছর আগেই পাখি কম আসা শুরু হয়, তবে এখন এই সমস্যাটা প্রকট। একটা সংরক্ষিত জলাশয় বাদে কোনো জলাশয়েই আসলে এখন তেমন পাখি নেই। এটার নানা কারণ রয়েছে। তার মধ্য অপরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো, অপরিকল্পিতভাবে গাছ কাটা, অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে প্রাণ-প্রকৃতির একটা অবনমন হয়েছে।
প্রথম আলো :
অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে প্রাণ-প্রকৃতি হুমকির মধ্যে পড়েছে বলে কি মনে করেন?
জামালউদ্দিন: এটা বাস্তব কথা এবং সত্য কথা। শুরুতে এই ক্যাম্পাসের জন্য পরিকল্পনাবিদ মাজহারুল ইসলাম যে মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) করেছিলেন, সে অনুযায়ী লেক সংবলিত একটি ক্যাম্পাস এবং গাছপালা রোপণ করে সুন্দর নৈসর্গিক একটা ইকোসিস্টেমভিত্তিক (বাস্তুতন্ত্র) ক্যাম্পাস হওয়ার কথা ছিল। সংগত কারণে ওই মাস্টারপ্ল্যানে তিনি ক্যাম্পাসের অবকাঠামোগুলো ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন এবং চারতলার বেশি উঁচু ভবন না করার জন্য চেয়েছিলেন। কারণ, এই ক্যাম্পাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পাখি, প্রাণিকুল ও সবুজ গাছপালা। যার উদ্দেশ্য ছিল প্রাণ-প্রকৃতির মধ্যে থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞানচর্চা করতে পারবে। কিন্তু সে চিন্তা থেকে এখন সরে আসা হয়েছে। প্রাণ-প্রকৃতির পাশাপাশি আমাদের যেভাবে পরিকল্পনামাফিক উন্নয়ন করার কথা ছিল, সেভাবে হয়নি। ক্যাম্পাসে ১০ তলা ভবন করার আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি না, সেটা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া যেত?
জামালউদ্দিন: অবশ্যই উদ্যোগ নেওয়া যেত। আমরা দাবি করেছিলাম একটি ইকোসিস্টেম বেজড মাস্টারপ্ল্যান যদি প্রফেশনাল এজেন্সি (পেশাদার সংস্থা) দিয়ে করা হতো, তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দৃষ্টিনন্দন এবং আর্ট অব স্টেট হতে পারত। সে জায়গায় অদক্ষতার সঙ্গে পরিকল্পনাহীন উন্নয়নের ফলে পরিযায়ী পাখি আসা বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ, অনেক বহুতল ভবন থাকলে পাখির ফ্লাইং জোন নষ্ট হয়ে যায়। সে পরিকল্পনাটা করতে প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে এই অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং আমাদের কালচারাল অ্যাপ্রোচ—এই দুটিই পাখি এবং প্রাণ-প্রকৃতি হুমকির মুখে পড়ে গেছে। বলা চলে এই ক্যাম্পাস এখন ইট-পাথরের একটি পিকনিক স্পট; বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বৈশিষ্ট্য, সেটি আর নেই।
প্রথম আলো :
যে প্রশাসনই দায়িত্বে আসে তারাই তড়িঘড়ি করে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে যেতে চায় কেন?
জামালউদ্দিন: আমাদের দেশে জনগণের মধ্যে বিশেষ করে সরকারের মধ্য ধারণা উন্নয়ন বলতে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন বোঝায়। কিন্তু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এখানে ছাত্রছাত্রীদের মানোন্নয়ন, শিক্ষকদের গুণগতমান এবং তার জন্য অবকাঠামো। এই তিনটা মিলে উন্নয়ন হয়। কিন্তু যখনই বিশ্ববিদ্যালয়ে যে উপাচার্য আসেন, তিনি মনে করেন বেশ কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করা হলো উন্নয়ন। কিন্তু সে উন্নয়নটা যদি পরিকল্পিতভাবে হতো, তাহলে আমরা ভাবতাম একটি উন্নয়ন হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন যে আসে, সে অবকাঠামো নির্মাণের দিকে ঝুঁকে যায়। এতে দুটি স্টেকহোল্ডারকে কোনো না কোনোভাবে খুশি করে। একটা হলো ঠিকাদার শ্রেণি, তারা অবকাঠামো উন্নয়নের নামে টাকা ব্যয় করার মধ্য দিয়ে একটা দুর্নীতির সুযোগ করে নেন। টাকার অপচয় করে। আর একটা হলো বিভিন্ন ধরনের গ্রুপ আছে আর্থিকভাবে, তারা খুব লাভবান হয়। লাভের কারণে তারা মিলেমিশে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী উন্নয়নের নামে আর্থিকভাবে লুটপাট করতে ব্যস্ত থাকে।
গত কয়েক বছরে গাছ কাটার ফলে ক্যাম্পাসের পরিবেশ এখন কোন দিকে যাচ্ছে?
জামালউদ্দিন: আমাদের দেশে বনভূমি আছে তিন ধরনের। প্রাইভেট, পাবলিক ও সংরক্ষিত বনায়ন। পাবলিক সম্পত্তিতে গাছ লাগিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। সে ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটা ভূমিকা পালন করে আসছিল। অতীতে ক্যাম্পাসে অনেক ভালো ভালো গাছ রোপণ করে বনায়ন করা হয়েছিল। এর মধ্যে অনেক গাছ অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে কাটা পড়ছে। অপরিকল্পিতভাবে গাছপালা বিনাশ হওয়ার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধুই গাছপালা না, এই গাছপালাকে ঘিরে যে ঝোপঝাড়, সেগুলোর মধ্যে অনেক প্রাণী বসবাস করে। আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রেও এগুলো কাজে লাগে, তা এখন নষ্ট হচ্ছে। যার ফলে ভারসাম্য বলতে যেটা বোঝায়, সেটা আসলে ভেঙে পড়ছে।
প্রথম আলো :
ক্যাম্পাসের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এই মুহূর্তে কোন কোন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?
জামালউদ্দিন: দীর্ঘ আন্দোলনের পরও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই মাস্টারপ্ল্যানটা আমি মনে করি রাষ্ট্র দায়িত্ব নিয়ে একটি কমিশনের মধ্যে করা জরুরি। এখনো সময় আছে একটা গ্রহণযোগ্য মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের মাধ্যমে চিহ্নিত করতে হবে, কোন উন্নয়নগুলো আমরা অপ্রয়োজনীয়ভাবে করেছি, যেটা পরিবেশের সঙ্গে যায় না। সেগুলোকে চিহ্নিত করে আমাদের থামানো দরকার অথবা মডিফিকেশন (সংশোধন) করা দরকার। সঙ্গে সঙ্গে কোন উন্নয়নগুলো খুবই জরুরি, তা-ও চিহ্নিত করতে হবে। তা না হলে আমাদের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা হবে না। আমি মনে করি অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে হোক বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হোক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বভিত্তিক মাস্টারপ্ল্যান করা খুবই জরুরি। তা না হলে যতটুকু জায়গা আছে, ততটুকু জায়গা আমরা আগামী দিনে স্বাচ্ছন্দ্যে বা পরিবেশসম্মতভাবে ব্যবহার করতে পারব না।