ভরদুপুরে মাত্র তিন শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছিলেন এক শিক্ষক আবিদা সুলতানা। তবে সেটা কোনো শ্রেণিকক্ষে নয়, একটি বাড়ির বারান্দায়। দৃশ্যটি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার ভাতুরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। একসময় কোলাহলমুখর ছিল যে বিদ্যালয়, আজ পরিত্যক্ত ভবনের কারণে আশ্রয় নিয়েছে পাশের বাড়ির বারান্দা আর একটি ছোট কক্ষে।
শুধু ভাতুরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়; একই উপজেলার জন্মেজয় ফজলুর রহমান সুলতান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উত্তর হারিনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও একই চিত্র। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, টিনশেডের অস্থায়ী ঘর, অন্যের বারান্দায় চলছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান। কমছে উপস্থিতি, ভয়ে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে চাইছেন না অভিভাবকেরা।
বারান্দাই শ্রেণিকক্ষ
উপজেলার শিলা নদীর পাড়ে ভাতুরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯২ সালে। দুই বছর পর, ১৯৯৪ সালে নির্মিত হয় বিদ্যালয়টির ভবন। সেখানে নিয়মিত পাঠ চললেও ২০১৯ সালে ভবনের ছাদের বিম ফেটে যায়। এ বছরের ২০ আগস্ট সেটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে প্রশাসন।
এরপর মাঠে টেবিল পেতে ক্লাস নিতে হতো। পরে শিক্ষা বিভাগের অনুরোধে বিদ্যালয়ের জমিদাতা পরিবারের সদস্য আলী আনোয়ার তালুকদার নিজের বাড়ির একটি কক্ষ ও বারান্দা ব্যবহার করতে দেন। বর্তমানে সেখানেই চলছে পাঠদান।
২৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে দেখা যায়, মাত্র তিন শিক্ষার্থী নিয়ে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক আবিদা সুলতানা। হতাশ হয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক আশা নিয়ে চাকরিতে যোগ দিলেও অবস্থা খুব খারাপ। ভবনের সমস্যা, রাস্তাঘাটের দুরবস্থা আর অভিভাবকদের অনাগ্রহে শিক্ষার্থীও কম। নতুন ভবন হলে হয়তো মানুষ সন্তানকে পাঠাতে আগ্রহী হতেন।’
কাগজপত্রে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৬। অথচ ২০১৯ সালেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৯৪। ছয়জন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও এখন কর্মরত পাঁচজন। বাড়ির একটি কক্ষে তৃতীয় শ্রেণির ৪ ও চতুর্থ শ্রেণির ১০ শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে ক্লাস করতে দেখা গেল।
শিক্ষার্থী তাবাসসুম আক্তার জানায়, ‘আমাদের স্কুল ভেঙে পড়ছে। অন্যের বাসায় এসে পড়তে হয়। আমরা নতুন স্কুল চাই।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাহবুবুল হক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ২০১৯ সাল থেকেই সমস্যা চলছে। ভবন না হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আর বাড়বে না।
টিনশেড ঘরে পাঠদান
জন্মেজয় ফজলুর রহমান সুলতান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৮ সালে। ২০২৩ সাল থেকে এর একমাত্র একতলা ভবনটি পরিত্যক্ত। এখন পাঠ কার্যক্রম চলছে পাশের টিনশেডের দোচালা ঘরে।
গরমে ক্লাসের ভেতর হাঁসফাঁস, বর্ষায় পানি জমে যায়। তারপরও শিক্ষকেরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে বিদ্যালয়ে নাম লেখানো আছে ১২০ শিক্ষার্থীর, তবে উপস্থিতি অনেক কম।
২৪ সেপ্টেম্বর দেখা যায়, মাত্র ১৩ শিক্ষার্থী নিয়ে তৃতীয় শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক রোকেয়া বেগম। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা গরমে কষ্ট পায়, বৃষ্টিতে মেঝে পানিতে ভরে যায়। উপস্থিতি কমে গেছে। যারা আসে, তাদের বসার জায়গা পর্যন্ত দিতে পারি না।’
নতুন বিদ্যালয় চাইল ফারহান আহমেদ ও নাজমা খাতুন নামের দুই শিক্ষার্থী।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহফুজা বিনতে হুদা বলেন, ২০২৩ সালে ছাদের পলেস্তারা ধসে পড়ে এক শিক্ষক আহত হন। তারপর ভবনে আর ক্লাস হয় না। মৌখিকভাবে বিদ্যালয়টি পরিত্যক্ত। আবেদন করলেও নতুন ভবন হচ্ছে না। অভিভাবকেরা সন্তানদের ক্লাসে দিতে চান না।
পরিত্যক্ত ভবনেই পাঠদান
উত্তর হারিনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালে। ২০০০ সালে তিন শ্রেণিকক্ষের একতলা ভবন নির্মিত হয়। তবে বর্তমানে সেটিও পরিত্যক্ত। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকি নিয়েই ভবনটিতে পাঠদান চলছে।
বিদ্যালয়ে এখন ২১১ শিক্ষার্থী আছে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. খালেকুজ্জামান বলেন, ‘দুই বছর ধরে অবস্থা খারাপ। শিক্ষা অফিস থেকে বলা হয়েছে, নিজস্ব ব্যবস্থায় টিনশেডের ঘর তুলে ক্লাস নিতে। কিন্তু টাকার অভাবে এখনো সম্ভব হয়নি।’
প্রশাসনের বক্তব্য
গত ২০ আগস্ট উপজেলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জরাজীর্ণ ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা কমিটির সভায় মোট ছয়টি বিদ্যালয় ভবনকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। এগুলো হলো ভাতুরি, পাকাটি, গাভী শিমুল, উত্তর হারিনা, বারবাড়িয়া ও বড়াইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিকল্পভাবে ক্লাস চালানোর নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা বিভাগ।
গফরগাঁও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. নূর-এ-আলম ভূঁইয়া জানান, ‘যেসব বিদ্যালয়ের ভবন পরিত্যক্ত করা হয়েছে, সেখানে বিকল্প অবস্থায় পাঠদান চলছে। আমরা অস্থায়ী স্থাপনার জন্য বরাদ্দ চেয়ে পাঠিয়েছি। বরাদ্দ এলেই অস্থায়ী স্থাপনা হবে, পরে স্থায়ী স্থাপনা করা হবে। তবে কোনোভাবেই পরিত্যক্ত ভবনে ক্লাস নেওয়া যাবে না।’