রংপুরের ‘ফকিরবাড়ি পল্লী জাদুঘর’

গ্রামোফোন হাতে ফকিরবাড়ি পল্লি জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা আতিকুর রহমান। ১১ ডিসেম্বর সকালে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার সাতভেন্টি এনায়েতপুর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

ফেলা আসা জীবন নিয়ে স্মৃতিকাতর হতে কার না ভালো লাগে। লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী আতিকুর রহমানের (আদিল) উপলব্ধিটা একটু অন্য রকম। তাঁর ভাবনা, বিজ্ঞানের কল্যাণে সমাজে পরিবর্তন আসবে ঠিকই, কিন্তু মা ও মাটিকে ভুলে নয়। তাই তিনি সংগ্রহ করতে শুরু করলেন এমন জিনিসপত্র, যা অতীতের স্মৃতিরোমন্থনে বারবার ফিরে আসে।

সংগৃহীত জিনিসপত্র দিয়ে আতিকুর রহমান একসময় গড়ে তোলেন একটি সংগ্রহশালা। নাম দেন ‘ফকিরবাড়ি পল্লী জাদুঘর’। রংপুর শহর থেকে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের জায়গীর হাটের দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। সেখানে থেকে জায়গীর-বালারহাট সড়ক ধরে ৮ কিলামিটার এগোলে মিঠাপুকুর উপজেলার কাফ্রিখাল ইউনিয়নের সাতভেন্টি এনায়েতপুর গ্রাম। পাকা সড়ক থেকে নেমে কাঁচা রাস্তায় চলার কিছুদূর পর ফকিরবাড়ি পল্লী জাদুঘর।

একসময় ব্যবহৃত হারিকেন ও কুপি
ছবি: প্রথম আলো

১১ ডিসেম্বর সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফুল আর লতাগুল্মবেষ্টিত গেট যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছে সংগ্রহশালার অতিথিদের। গাছগাছালির ছায়াঘেরা সংগ্রহশালার বিভিন্ন প্রান্তে বসানো হয়েছে বইয়ের তাক। বই পড়তে বানানো হয়েছে স্টিলের চেয়ার, টেবিল ও বেঞ্চ। বই পাঠরত পার্শ্ববর্তী রাধাভল্লব গ্রামের শিক্ষার্থী মো. মোনারু সংগ্রহশালা নিয়ে বললেন, ‘গ্রামবাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে লালন করার চমৎকার প্রয়াস আছে এখানে। মাঝেমধ্যে এসে বই পড়ি। ভালো লাগে।’

এই সংগ্রহশালায় রয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাওয়া ষাট থেকে নব্বই দশকের গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নানা সামগ্রী। এখানে আছে সিন্দুক থেকে যাত্রাগানের রাজা-বাদশাহর তরবারির মতো দুর্লভ জিনিসপত্র। আছে গ্রামোফোন (কলের গান), ঢেঁকি, হ্যাজাক বাতি, হারিকেন, কুপি, তালপাতার পাখা, একতারা, দোতারা, ডুগডুগি, গরুর গাড়ি, জাঁতা, হুঁকা, ঝাঁজর, খড়ম, গান্টার শিকল, হামানদিস্তা, রেডিও, ভিসিআরসহ প্রায় ৩০০ কৃষি ও সাংস্কৃতিক উপকরণ। এ ছাড়া সংগ্রহে রয়েছে ১৮৩ দেশের ডাকটিকিট। দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এসব দেখতে আসেন।

আতিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাদুঘরের কথা কিন্তু মা–বাবাকে বলা যায়নি। বলতে হয়েছে খামার বানাব। তখন পরিবার সমর্থন করে। বলি, ভুট্টার ব্যবসা করব। কিন্তু আমার টার্গেট হলো কীভাবে জাদুঘরে বানানো যায়। ২০১৬ সালে যখন দেখলাম ঘরটা বানানো হয়ে গেল, তখন জিনিসপত্র ধীরে ধীরে নিয়ে আসা শুরু করি। একসময় পরিবার জানতে পেরে মেনে নেয়।’

আতিকুর জানান, ২০০৫ সালে তিনি তখন রংপুরের কারমাইকেল কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। ছাত্রাবস্থায় টিউশনির পাশাপাশি লেখালেখি শুরু করেন আদিল ফকির নামে। তবে তাঁর নেশা হয়ে ওঠে পুরোনো জিনিসপত্র সংগ্রহ করা। ২০১৩ সালে গ্রামে বাড়ির পাশে ১০ শতক জমি কেনেন। ২০১৬-১৭ সালের দিকে জাদুঘরের জন্য একটি আধাপাকা ঘর নির্মাণ করেন। দুই একর ৩১ শতাংশ জমির ওপর এখন ফকিরবাড়ি পল্লী জাদুঘর। আছে পদ্মদিঘি। দিঘির পাশে একসময়ের দুর্গম রাস্তাঘাটের আদলে বানানো হয়েছে বাঁশের সাকো। গ্রামবাংলার জীবনযাপনকে তুলে ধরতে তৈরি করা হচ্ছে কুড়েঘর।

অনেক আগের ব্যবহৃত হুক্কা
ছবি: প্রথম আলো

সংগৃহীত এসব জিনিসের প্রতিটির আলাদা গল্প আছে। সংগ্রহশালায় যে দোতারাটি আছে, সেটি আবুল কাশেম নামে স্থানীয় একজনের। তিনি দোতারা দিয়ে একসময় গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু গ্রামে এখন যেতে পারেন না। সংরক্ষণের জন্য দোতারাটি সংগ্রহশালায় দিয়েছেন তিনি। গ্রামোফোনটি তাঁর বান্ধবী নিলুফা আক্তারের দাদার। সংগ্রহশালার কথা জানতে পেরে নিলুফা এটি তাঁকে দেন। এভাবে প্রতিটি সংগ্রহে মানুষের ভালোবাসা আছে। এগুলোর দাতার নাম উল্লেখ করে প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান আতিকুর।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আতিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি চাই, আমাদের এখানে পুরোনো গান বাজবে, কেউ কেউ কবিতা পাঠ করবেন। স্থানীয় মৃৎশিল্পীরা তাঁদের কাজ এখানে প্রদর্শন করবেন। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী স্বাস্থ্যশিবির, বনজ সংগ্রহ মেলা ও স্থানীয় উৎপাদিত ফসল বিক্রির ব্যবস্থা থাকবে এখানে। জাদুঘরের প্রতিটি বিষয় থাকবে অর্থবহ, স্মৃতি, শিক্ষা ও সভ্যতার প্রতিফলন।’

রংপুরের বাসিন্দা সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা আল আমিন জাদুঘরের রেজিস্ট্রার বইয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘গ্রামবাংলার ঐতিহ্যকে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে। সংগ্রহগুলো দেখে নিজের শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম।’

কাফ্রিখাল ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘ভালো একটা উদ্যোগ। আমাদের ইউনিয়নের জন্য এটা গর্বের বিষয়।’

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফকিরবাড়ি পল্লী জাদুঘর নিয়ে আদিলের যে কর্মস্পৃহা, আগ্রহ ও আবেগ, সবকিছু মিলে এই জাদুঘর দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠবে। একই সঙ্গে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের একটি বড় সংগ্রহশালা হবে।’