‘ভালো মাইনষের’ দই
দোকানের নাম নেই, ঘরও নেই। কিন্তু দইয়ের একটা নাম আছে। ‘ভালো মানুষের’ দই। স্থানীয় লোকজন অবশ্য বলেন, ‘ভালো মাইনষের দই’। কথাটা শুনে অনেকের মনে হতেই পারে ভালো মানুষ বলে আজকের দিনে একজন মানুষের ‘ব্র্যান্ডিং’ হতে পারে! কিন্তু একসময় নাকি একনামেই বিক্রি হয়েছে ভালো মাইনষের দই। এই দই এখনো পাওয়া যায় নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার পারসোমবাড়ি বাজারে।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে পারসোমবাড়ি বাজারে পৌঁছে সেখানকার এক দোকানিকে জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘ভালো মাইনষের দই? ওই যে ওই গলি দিয়ে ঢুকে দেখেন।’
গলিতে ঢুকতেই দেখা গেল ঘর নেই, সাইনবোর্ডও নেই। শুধু মাথার ওপরে একটা পলিথিন টাঙানো। টেবিলের ওপরে সাজিয়ে রাখা কতগুলো দইয়ের ভাঁড়। পাশের দোকানি আবদুস সালাম বললেন, এটাই সেই দোকান। কিন্তু দোকানে কেউ নেই। শুধু একটি ছোট টেবিল ফ্যান ঘুরছে। আশপাশের দোকানদারদের কাছ থেকে জানা গেল, আট বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন ‘ভালো মানুষ’। এর পর থেকে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। এখন আর দোকানে বসেন না।
জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘সবাই ডাকে ভালো মাইনষের দই। তাই হামরাও কই। হামার জরমের (জন্মের) আগ থাইকি চলতিচে।’
দোকানি আবদুস সালাম বললেন, ভালো মানুষের নাতি আজ দোকানে ছিল। বোধ হয় খেতে গেছে। একটু পরই হয়তো সে চলে আসবে।
এই ফাঁকে জানার চেষ্টা করলাম লোকটার নাম ভালো মানুষ হলো কীভাবে। পাশেই নানা রকম মিষ্টির পসরা সাজিয়ে বসেছেন আল–আমিন। জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘সবাই ডাকে ভালো মাইনষের দই। তাই হামরাও কই। হামার জরমের (জন্মের) আগ থাইকি চলতিচে।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই দোকানে এল ভালো মানুষের নাতি তানভীর আহমেদ। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে সে। তার বাবা প্রায় দুই বছর আগে মালয়েশিয়া গেছেন। মা এই ব্যবসায় নানাভাবে সহায়তা করেন।
কিছুক্ষণ পর অবশ্য দোকানের সামনে পাওয়া গেল ভালো মানুষকে। তানভীর বলে উঠল, ‘ওই যে দাদু।’
প্রায় ৪০ বছর ধরে বিক্রি হচ্ছে তাঁর এই দই। দুই আকারের হাঁড়ির মধ্যে ছোট হাঁড়ি ১৫০ টাকা, বড় হাঁড়ি ৩২০ টাকা দরে বিক্রি হয়। দিনে ১০০ হাঁড়ির মতো বিক্রি হয়, তবে বিয়েশাদি বা অনুষ্ঠানের মৌসুমে ৫০০ হাঁড়ি পর্যন্ত বিক্রি হয়।
দোকানে বসতে বললে, হাসতে হাসতে দোকানে এসে বসলেন। তাঁর আসল নাম মুজিবুর রহমান। বয়স কত জানতে চাইলে বললেন, ৬০-৭০ বছর হবে। তাঁর নাতি বলেছিল, দাদু কথায় কথায় রেগে যায়। কিন্তু কথাবার্তায় তার কিছুই বোঝা গেল না। পেশাদার দোকানির মতো তাঁর দই কেন সবার চেয়ে ভালো, সেই ব্যাখ্যা দিলেন। জানতে চাইলাম, তাঁর নাম ভালো মানুষ কীভাবে হলো। তিনি হাত দুটি ওপরে তুলে বললেন, ‘ওপরওয়ালা জানে, বাবা। তা তুমি হামার নাম জানলে কী কইর্যা?’
মানুষের মুখ থেকে শুনে এসেছি, এ কথা শুনে তাঁর চোখ ছলছল করে উঠল।
প্রায় ৪০ বছর ধরে বিক্রি হচ্ছে তাঁর এই দই। দুই আকারের হাঁড়ির মধ্যে ছোট হাঁড়ি ১৫০ টাকা, বড় হাঁড়ি ৩২০ টাকা দরে বিক্রি হয়। দিনে ১০০ হাঁড়ির মতো বিক্রি হয়, তবে বিয়েশাদি বা অনুষ্ঠানের মৌসুমে ৫০০ হাঁড়ি পর্যন্ত বিক্রি হয়।
অনেকক্ষণ কথা হলেও তাঁর বেশ কিছু কথা বোঝা গেল না। যেমন বোঝা গেল না তাঁর এই ব্যবসা শুরুর গল্পটাও।