কাঠ ও ব্যাটারি পুড়িয়ে পরিবেশের বারোটা

  • দুটি কারখানার মালিক বর্তমান ও সাবেক দুই জনপ্রতিনিধি।

  • কারখানার ধোঁয়ায় অনেক গাছে ফল ধরছে না।

  • কারখানার আশপাশের বাসিন্দারা নানা রোগে ভুগছেন।

ঢাকার ধামরাই উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এসব কয়লা বিক্রি করার পাশাপাশি ব্যাটারি পোড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

লোকালয়ের পাশে বাঁশঝাড়ের মধ্যে টিন দিয়ে ঘেরা একটি কারখানা। সেখানকার ১০টি গোলাকৃতির চুল্লিতে পুড়ছে কাঠ। পোড়া কাঠের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারপাশ। এভাবে কাঠ পুড়িয়ে বানানো হচ্ছে কয়লা। আবার পাশেই রয়েছে সেই কয়লা দিয়ে পুরোনো ব্যাটারি গলিয়ে সিসা বের করার ব্যবস্থা। যেন পরিবেশ ধ্বংসের আয়োজন। কারখানাটির অবস্থান ধামরাইয়ের বাইশাকান্দা ইউনিয়নের রঘুনাথপুরে।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কারখানা ঘুরে দেখা যায়, কারখানার নিরাপত্তার জন্য ফটকে লাগানো হয়েছে সিসিটিভি। ভেতরে সারবদ্ধভাবে বানানো হয়েছে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির ১০টি চুল্লি। বেশ কয়েকটি চুল্লি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। বাকিগুলোর ভেতরে কাঠ দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। পাশেই রয়েছে সিসা তৈরির কারখানা। কথা হয় ওই কারখানার কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে। তাঁরা জানান, কয়লা উৎপাদনের পর পাশে সিসা কারখানায় পুরোনো ব্যাটারির ওপরের অংশ খুলে প্লেট (ব্যাটারির ভেতরে থাকা পাত) বের করা হয়। রাতে চুল্লির মধ্যে কাঠ ও কয়লায় ব্যাটারির প্লেট আগুন দিয়ে গলিয়ে বের করা হয় সিসা।

কাঠ পুড়িয়ে কয়লা এবং ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরির কাজে যুক্ত ব্যাক্তিরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকেন। অন্য ব্যক্তিদের জন্যও এটি ভয়ংকর।

সিসা বানানোর প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এমন একাধিক শ্রমিক জানান, প্রতিটি চুল্লিতে ২০০ থেকে ৩০০ মণ কাঠ সাজিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে চুল্লির মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। চুল্লির ছোট আকৃতির কয়েকটি চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বের হওয়ার সুযোগ রাখা হয়। ৭ থেকে ১০ দিন পুড়ানোর পর চুল্লির ভেতর থেকে কয়লা বের করে ঠান্ডা করা হয়। ওই কয়লা বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয়। তবে এ দুটি কারখানার পাশাপাশি ব্যাটারি গলিয়ে সিসা তৈরির অপর একটি কারখানা থাকায় ওই কয়লা ব্যবহার করা হয় সিসা তৈরির কাজে। সিসা তৈরির ক্ষেত্রে শুরুতে পুরোনো ব্যাটারির ওপরের অংশ খুলে প্লেট বের করা হয়। চুলায় কয়লার আগুনে প্লেটগুলো গলানো হয়। সেখান থেকেই বেরিয়ে আসে সিসা।

কয়লা ও সিসা তৈরিতে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব সিসা পরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করা হয়। কাঠ পুড়িয়ে প্রতিটি চুল্লি থেকে সপ্তাহে প্রায় ৫০ হাজার টাকার কয়লা পাওয়া যায়। সে হিসাবে সপ্তাহে ১০ চুল্লি থেকে আয় হয় প্রায় ৫ লাখ টাকা। প্রতি কেজি সিসার দাম প্রায় ৩৫০ টাকা। এক টন ব্যাটারি গলালে ৬৫০-৬৮০ কেজি সিসা পাওয়া যায়।

রঘুনাথপুরের কারখানাটির মালিক ধামরাই উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী শামীম রহমান। কারখানাটি বৈধ বলে দাবি করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র থেকে শুরু করে কারখানা পরিচালনার কাগজপত্র আছে বলেই আমরা কারখানা চালাচ্ছি।’

কারখানাটি অবৈধ বলে জানিয়ে ধামরাইয়ের বন কর্মকর্তা মোতালিব-আল-মোমিন প্রথম আলোকে বলেন, কারখানাটি গুঁড়িয়ে দিতে কিছুদিন আগে ওই এলাকায় গেলেও বৃষ্টির কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। এ সপ্তাহে কারখানাটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ধামরাইয়ের যাদবপুর ইউনিয়নের গোলাকান্দায় এমন আরেকটি কারখানায় আটটি চুল্লিতে কয়লা তৈরি করা হয়। একই ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ফরহাদ হোসেন এ কারখানার মালিক। ফরহাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক আগে সিসা পোড়ানোর কারখানাটি আমার ছিল। এখন আর নেই। এখন স্থানীয় ছেলেপেলে কয়লা তৈরির কারখানা চালায়।’

এসব ধোঁয়ার স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কথা হয় ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নূর রিফফাত আরার সঙ্গে। তিনি বলেন, কাঠ পুড়িয়ে কয়লা ও ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরির কাজে যুক্ত ব্যক্তিরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকেন। সিসা ও কাঠ পুড়িয়ে কয়লা উৎপাদনের এলাকায় অ্যালার্জি, চর্মরোগ, চোখের সমস্যা, রক্তশূন্যতা, শ্বাসকষ্ট, হৃদ্‌রোগ এমনকি ক্যানসারের মতো জটিল রোগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এ বিষয়ে ধামরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি কারখানা গুঁড়িয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গোলাকান্দার কারখানাটি কিছুদিন আগে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। নতুন করে তারা আবার শুরু করেছে, এটি জানা ছিল না। শিগগিরই ওই কারখানাসহ বাকিগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কয়লা ও সিসা কারখানার ধোঁয়ায় অতিষ্ঠ গ্রাম দুটির অনেক বাসিন্দা। তবে ভয়ে নাম প্রকাশ করতে নারাজ তাঁরা। তাঁদের ভাষ্য, এসব কারখানার ধোঁয়ায় কয়েক বছর ধরে অনেক গাছে ফল ধরছে না। যত দিন চুল্লি জ্বলে, তত দিন ঠান্ডা–সর্দিতে ভোগেন আশপাশের বাসিন্দারা। অবিলম্বে এসব চুল্লি বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানান তাঁরা।