কুমিল্লায় দিঘির পাড়ে পৌনে ৪০০ বছরের নান্দনিক মসজিদ

কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার শরীফপুর গ্রামে অবস্থিত শরীফপুর শাহী জামে মসজিদটি মুঘল আমলের স্থাপত্যের অন্যন্য এক নিদর্শনছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার শরীফপুর শাহী জামে মসজিদ। পৌনে ৪০০ বছর আগে নির্মিত মসজিদটি মুঘল আমলের স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। মসজিদের পাশে বিশাল আকারের নাটেশ্বর রাজার দিঘি। দিঘির পাড়ে আছে এক ধর্মগুরুর মাজার। দিঘির শান্ত জলরাশির সঙ্গে মসজিদের নান্দনিক সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। প্রতিদিনই দূর-দূরান্তের মানুষ এখানে ভিড় করেন।

কুমিল্লা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে মনোহরগঞ্জের বাইশগাঁও ইউনিয়নের শরীফপুর গ্রামে মসজিদের অবস্থান হলেও কালের সাক্ষী হিসেবে ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ স্থাপনাটি মূলত তিন জেলার মিলনস্থলে পড়েছে। উত্তর-পশ্চিমে চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে কিছু দূর এগোলেই নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলা।

মসজিদের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে নাটেশ্বর দিঘি। ৩৫ দশমিক ২৯ একর আয়তনের সুবিশাল দিঘির পাড়ে পূর্ব-উত্তর কোণে মসজিদের অবস্থান।

মনোহরগঞ্জের বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ বলেন, এখানে মানুষের ভিড় করার আরেকটি কারণ হলো, দিঘির পূর্ব পাড়ে হজরত সৈয়দ শাহ শরিফ বাগদাদি নামের এক ধর্মগুরুর মাজার আছে। মসজিদ, দিঘি ও মাজার ঘিরে প্রতিনিয়ত দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কুমিল্লা কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মনোহরগঞ্জের বাইশগাঁও ইউনিয়নের শরীফপুর গ্রামে ১৬৫৭ সালে দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। ৩৬৮ বছর আগে নির্মাণ করা হলেও মসজিদটির সৌন্দর্য এখনো অটুট। চুন-সুরকির মসজিদটি দেখতে প্রতিদিনই মানুষ ভিড় করেন। অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে এসে নামাজ আদায় করেন। মুঘল আমলে নির্মিত মসজিদটি তৎকালীন স্থাপত্যের অনন্য এক নিদর্শন। মসজিদটির বাইরের দৈর্ঘ্য ১৪ দশমিক ৪৮ মিটার ও প্রস্থ ৫ দশমিক ৯৪ মিটার। মসজিদের ওপরে তিনটি গম্বুজ আছে। আয়তাকার মসজিদটির পূর্ব দিকে তিনটি খিলানযুক্ত দরজা আছে, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় দরজাটি অপেক্ষাকৃত বড়। দরজাগুলোর বিপরীত দিকে পশ্চিমে তিনটি মেহরাব আছে। কেন্দ্রীয় মেহরাবটি অন্য মেহরাব দুটির তুলনায় বড়।

মসজিদের চার কোণে চারটি বড় অষ্টভুজাকার মিনার আছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের ওপরে দুটি অষ্টভুজাকার মিনার আছে। কেন্দ্রীয় গম্বুজটি অপেক্ষাকৃত বড়। গম্বুজের ভেতরের অংশ পাতার নকশা। বাইরের অংশে চক্র নকশার কাজ। মসজিদের সামনের দেয়ালে ফারসি ভাষার শিলালিপি আছে। সেখানে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা হায়াতে আবদুল করিমের নাম লেখা আছে। এলাকাবাসীর কাছে তাঁর পরিচয় নিয়ে দুই ধরনের মত প্রচলিত। একটি হলো, হায়াতে করিম দিঘি খননকারী নাটেশ্বর রাজার কর্মকর্তা ছিলেন। অন্যটি হলো, তিনি দিঘির পাড়ে থাকা মাজারের ধর্মগুরুর মুরিদ ছিলেন।

মসজিদ দেখতে আসা চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার শ্যামপুর গ্রামের আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, কয়েকবার মসজিদটি দেখতে এসেছেন। বিশেষ করে দিঘির পাড়ে মসজিদ হওয়ায় খুব সুন্দর লাগে। এখানে এলে মসজিদ ও দিঘির শান্ত জলরাশি দেখে মনটা শান্ত হয়ে যায়।

মনোহরগঞ্জের বাইশগাঁও ইউনিয়নের শরীফপুর গ্রামে ১৬৫৭ সালে দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি নির্মাণ করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লায় ১৬৫৮ সালে প্রথম ঐতিহাসিক শাহসুজা মসজিদটি নির্মিত হয়। সেই বিবেচনায় শরীফপুর ও শাহসুজা মসজিদ দুটি সমসাময়িক বলে মনে করেন কুমিল্লার ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর। তিনি বলেন, মুঘল শাসনামল থেকেই কুমিল্লা অঞ্চলে ইসলামের বিকাশ ঘটে। তখনই মনোহরগঞ্জের শরীফপুর ও কুমিল্লার শাহসুজা মসজিদ নির্মিত হয়। শরীফপুর মসজিদটি মুঘল আমলের স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন। নাটেশ্বর দিঘির পাড়ে একজন ধর্মগুরুর মাজার আছে। ধারণা করা হয়, তিনি বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য এ অঞ্চলে আসেন। এখনো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তাঁর অনেক ভক্ত আছে।

শরীফপুর শাহী জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মোহাম্মদ সামছুদ্দোহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিনই অনেকে মসজিদটি দেখতে আসেন। বিশেষ করে শুক্রবার অনেক দূরের মানুষও এখানে নামাজ পড়তে আসেন। আমরা চেষ্টা করি মসজিদের সৌন্দর্য যেন নষ্ট না হয়।’

মসজিদ পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি মোতাহার হোসেন চৌধুরী বলেন, মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। তাঁরা ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতনসহ সার্বিক বিষয় দেখাশোনা করেন। ছয় বছর আগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদে সংস্কারকাজ করেছিল। বর্তমানে মসজিদের সৌন্দর্য রক্ষায় জরুরি কিছু সংস্কার দরকার। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিষেধ থাকায় তাঁরা নিজস্ব উদ্যোগে কিছু করছেন না। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে বিষয়টি জানিয়েছেন।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের (কুমিল্লা কার্যালয়) আঞ্চলিক পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান বলেন, শরীফপুর শাহী জামে মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করা। মসজিদের কিছু সংস্কার দরকার। তাঁরা চেষ্টা করছেন। তিন জেলার সীমান্ত এলাকায় মসজিদ, দিঘি ও মাজার ঘিরে একটি প্রত্ন পর্যটনকেন্দ্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। তাঁরা মসজিদের নান্দনিক সৌন্দর্য বজায় রাখার চেষ্টা করছেন।