মুন্সিগঞ্জে বিএনপির বিরোধ: এক সপ্তাহের মাথায় আরেকজনকে গুলি করে হত্যা
মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার চরাঞ্চলে বিএনপির দুই পক্ষের বিরোধের জের ধরে এক সপ্তাহের ব্যবধানে আরও একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আজ সোমবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে উপজেলার চর ডুমুরিয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় আরও একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
নিহত ব্যক্তির নাম আরিফ মীর (৪০)। তিনি মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের ডুমুরিয়া এলাকার বাসিন্দা। আহত ব্যক্তির নাম ইমরান খান (২২)। তিনি একই এলাকার আক্তার খানের ছেলে।
মোল্লাকান্দি ইউনিয়নে বিবদমান দুটি পক্ষের একটির নেতৃত্বে আছেন ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ওয়াহিদ রায়হান ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আতিক মল্লিক। অপর পক্ষের নেতৃত্বে আছেন সদর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক উজির আহমেদ ও ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সহসভাপতি আওলাদ হোসেন। নিহত আরিফ মীর উজির-আওলাদের সমর্থক ছিলেন।
এর আগে ২ নভেম্বর রাতে দুই পক্ষের বিরোধে ওয়াহিদ-আতিক মল্লিকদের সমর্থক হিসেবে পরিচিত তুহিন দেওয়ান (২২) নামে এক তরুণকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
মুন্সিগঞ্জ সদর থানা থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব প্রায় এক ঘণ্টার। সেখানে পুলিশ ফোর্স তৈরি করে যেতে আমাদের সময় লেগেছে। তবে বর্তমানে ওই এলাকায় পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে।মো. সাইফুল আলম, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মুন্সিগঞ্জ সদর থানা
আধিপত্যের লড়াই চলে সব আমলে
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, মোল্লাকান্দি ইউনিয়নে বসবাসকারী সে দলের নেতারা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যান। সমর্থকদের নিয়ে সংঘর্ষে জড়ান তাঁরা। আওয়ামী লীগের আমলে পক্ষ দুটির নেতৃত্ব দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। তখন বিএনপির সমর্থকেরা ওই দুই পক্ষে ভাগ হয়ে সংঘর্ষে জড়াতেন।
বিএনপির বড় নেতারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগের নেতাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতেন। গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আধিপত্যের লড়াইয়ে সামনে আসেন বিএনপির নেতারা। তখন থেকে শুরু হয় বিএনপির নেতাদের আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি। তাঁরাও দল ভারী করতে আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীদের এলাকায় এনে নিজেদের দলে ভেড়ান। বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় সংঘর্ষ, গোলাগুলি আর মারামারির রাজনীতি। ৫ সেপ্টেম্বর দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে আটজন গুলিবিদ্ধ হন।
আজকের ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
এ ছাড়া বিভিন্ন সময় এলাকায় এই দুই পক্ষের লোকজন হাতাহাতি ও বাগ্বিতণ্ডায় জড়াচ্ছেন। ২ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে তুহিন নামে এক কৃষক লীগ নেতার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর জের ধরে আজ সোমবার ভোরে ওয়াহিদ রায়হান, আতিক মল্লিক ও রহিম মোল্লাদের সমর্থক আওয়ামী লীগ নেতা ইউসুফ, জাহাঙ্গীর, শাহ কামাল, শাহ আলম, শাকিল, হোসেন মিয়া ও জিন্নত মীরদের একটি দল দেশি-বিদেশি অস্ত্র নিয়ে চর ডুমুরিয়া এলাকায় অতর্কিতে হামলা চালায়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান আরিফ মীর। ইমরান খান গুরুতর আহত হন। পরে দুজনকে উদ্ধার করে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে আনা হয়।
মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক রুহুল আমিন বলেন, সকাল ছয়টার দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দুজনকে হাসপাতালে আনা হয়। তাঁদের মধ্যে আরিফ মীর হাসপাতালে আনার আগেই মারা যান। আহত ইমরানকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
প্রাণ বাঁচাতে লুকিয়ে ছিলেন, সেখানেই গুলি
নিহত ব্যক্তির স্ত্রী পারুল বেগম বলেন, তিনি স্বামীকে ছেলে-মেয়েদের দোহাই দিয়ে এসব ঝগড়ায় যেতে না করতেন। আজ ফজরের আজানের পর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘর থেকে বের হন তাঁর স্বামী। শৌচাগার থেকে শাহ কামাল, শাহ আলমদের হাতে অস্ত্র দেখে সেখান থেকে বের হয়ে কলাগাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। সেখানেই তাঁর বুকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এ বিষয়ে সদর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক উজির আহমেদের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি ধরেননি। অভিযোগের বিষয়ে জানতে প্রতিপক্ষের নেতৃত্বে থাকা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ওয়াহিদ রায়হানের মুঠোফোনেও একাধিকবার কল করা হয়। তিনিও সাড়া দেননি।
তবে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আতিক মল্লিক বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে তিনি কোনোভাবে সম্পৃক্ত নন। আজকে যাঁরা ঘটনা ঘটিয়েছেন, এটি তাঁদের দায়দায়িত্ব। উজির আহমেদ ও আওলাদ হোসেনরা এলাকায় আওয়ামী লীগের লোকজনকে ভিড়িয়ে বিএনপির লোকজনকে এলাকা থেকে তাড়িয়ে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছেন।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ
ফাতেমা আক্তার নামে স্থানীয় এক নারী বলেন, বিএনপির ছত্রচ্ছায়ায় আওয়ামী লীগের ইউসুফ–জাহাঙ্গীররা এলাকায় তাণ্ডব চালাচ্ছেন। ঘরবাড়ি ভাঙচুর করছেন। অস্ত্র নিয়ে গুলি করে মানুষ হত্যা করছেন। ঘটনার সময় এলাকার লোকজন পুলিশকে জানায়। পুলিশ তখন না গিয়ে দুই ঘণ্টা পরে এলাকায় যায়। সময়মতো এলাকায় পৌঁছালে হয়তো প্রাণহানির ঘটনা ঘটত না। এ ছাড়া যতবার এলাকায় এ রকম ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ পক্ষগুলো থেকে সুবিধা নিয়ে ঘটনাগুলোকে গুরুত্ব দেয়নি। এর ফলে একের পর এক সংঘর্ষ, মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
এলাকায় গোলাগুলির ঘটনা জানালেও সময়মতো ঘটনাস্থলে না পৌঁছানো এবং পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। মুন্সিগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাইফুল আলম ঘটনাস্থলে এক ঘণ্টা পরে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
প্রথম আলোকে ওসি বলেন, ‘মুন্সিগঞ্জ সদর থানা থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব প্রায় এক ঘণ্টার। সেখানে পুলিশ ফোর্স তৈরি করে যেতে আমাদের সময় লেগেছে। তবে বর্তমানে ওই এলাকায় পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে।’