ঘাটশ্রমিকদের জীবন যেমন...
খুলনা নদীবন্দরের ৭ নম্বর রুজভেল্ট ঘাট জেটিতে শ্রমিকদের কয়েকটি দল বেলা শেষের কাজে ভীষণ ব্যস্ত। কোনো কোনো দলের আবার কাজ শেষ। ভৈরবের ঘোলা পানিতে সমানে ডুবাচ্ছে তারা। সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির কষ্ট থেকে প্রশান্তি পেতে গোসলের ঘাটে চলছে রাজ্যের গল্প আর হাসি-তামাশা।
সে দলের একজন মো. জহুর। অভিভাবকসুলভ ভঙ্গিতে সবাইকে পানি থেকে তাড়াতাড়ি ওঠার তাগাদা দিয়ে নিজেই উঠে পড়লেন। ভেজা কাপড় ছেড়ে শুকনা লুঙ্গি পরলেন। অন্যরাও একে একে ওপরে উঠতে শুরু করেছেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দল বেঁধে হাঁটা শুরু হলো। পেছনে পড়লেন জহুর। কোথায় যাবেন এখন—জানতে চাইলে তাঁর উত্তর, ‘আমাদের ডেরায় ফিরছি। একটু সামনেই আমাদের মেস।’
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে পরিচয় বিনিময় হলো। তাঁদের মেসে যাওয়ার প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হলেন। রুজভেল্ট জেটি ঘাটের মূল ফটকের পাশেই জহুরদের মেস। তাঁদের দলনেতা বাবুল গাজীর নামে পরিচিত বাবুল সরদারের মেস। লম্বা টিনের ঘর। মেঝেতে হোগলার চাটাই আর সিমেন্টের খালি বস্তা বিছানো। ঘরজুড়ে টাঙানো দড়িতে কাপড় মেলে দেওয়া।
ছোটখাটো চেহারার বাবুল সরদার আস্তানায় ফিরেই ব্যস্ত হয়ে গেছেন। তড়িঘড়ি করে কিছুটা পরিপাটি হয়ে বিদায় নিলেন। শ্রমিকদের মজুরির টাকা আনতে তাঁকে ইউনিয়ন অফিসে যেতে হচ্ছে।
এদিকে আস্তানায় ফিরে কেউ ব্যস্ত তেল মাখায়, কেউ রাতের খাবার সেরে নিচ্ছেন, কেউ মশারির কোনাটা আগে থেকেই ঠিক করে রাখছেন। অন্যদের মধ্যে ছয়-সাতজন কাছাকাছি ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে সঙ্গ দিলেন। জানা গেল, এই দলের শ্রমিকেরা ৫ থেকে ১৬ বছর ধরে ঘাটে কাজ করেন। বেশির ভাগের বাড়ি বটিয়াঘাটার সুরখালী ইউনিয়নে। ডুমুরিয়া, দাকোপের লোকজনও আছে। সবাই বলতে গেলে পরস্পর আত্মীয়স্বজন। একজন আরেকজনকে ডেকে এনে দল বেঁধেছেন।
৭ নম্বর ঘাটে সাতটি পয়েন্ট আছে। ১ নম্বর পয়েন্টের নাম ফুড পয়েন্ট। সেখানে চাল, গম—এসব খালাস হয়। বাকি ছয়টি পয়েন্টে খালাস হয় নানা পদের সার। একেক পয়েন্টে একেকজন সরদার। সাধারণ শ্রমিকের মতো উপার্জনের একটা ভাগ সরদারেরা পান। এর ওপর বস্তাপ্রতি ২৫ পয়সা করে আলাদা পান তাঁরা। শ্রমিক ও নেতাদের পেছনে টুকটাক খরচও করতে হয় তাঁদের। ৭ নম্বর পয়েন্টের সরদার বাবুল গাজী।
বাবুল সরদারের মেসে এখন জনাবিশেক লোক। বর্ষাকালে গ্রামের দিকে কৃষিকাজ থাকায় মেসে তেমন লোক নেই। লোক থাকলে ৬০ জন পর্যন্ত হয়। ছোট ঘরে জায়গার সংকুলান না হওয়ায় তখন অনেকে ঘাটে, পন্টুনে রাত কাটান।
গল্পে গল্পে ইউনূস নামের এক শ্রমিক বলেন, সপ্তাহের শেষে কাপড় কাচতে একটি সাবান লাগবেই। যে যেখানে পারেন শুয়ে পড়েন। সারা রাত এর মধ্য দিয়ে লোকজন চলাফেরা করবে। কেউ তো কাউকে দেখে হাঁটবে না। কেউ জুতা পায়ে আসবে, কেউ খুলে আসবে। কেউ জুতা কোনো দিন পায়ে দেবে না—এভাবেই আসবে। সপ্তাহভর এটা চলবে।
ইউনূসরা কাজে লেগে পড়েন সাড়ে ছয়টার মধ্যে। সকালে কোনো দিন ৯টায়, কোনো দিন ১০টায় খাওয়া হয়। দুপুরেও নির্ধারিত কোনো সময় নেই। ইউনূস বলেন, ‘আমাগে একটা কাজের ভাব আছে। সেটা শেষ হলে খাওয়া। মাগরিবের আজানের পর গোসল, এসে তেল মেখে খাওয়া–দাওয়া শেষ। এরপর কেউ একটু তাস খেলে, কেউ একটু হেঁটে আসে, কেউ শুয়ে পড়ে।’
বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ি গিয়ে শনিবার সকালে ফেরেন তাঁরা। বেশির ভাগই বাড়ি থেকে খাবার আনায় শনিবারে মেসে রান্না হয় না। বাড়ি থেকে আনা খাবার খেয়ে নিচ্ছিলেন আসাবুর গাজী। তিনি এখানকার বাবুর্চি। ঘাটে গিয়ে কাজ না করলেও শ্রমিকদের মজুরির সমান ভাগ পান। আসাবুর বলেন, রোববার সকাল থেকেই চালু হয় খাবার। সকালে ডাল-আলুভর্তা, দুপুরে সবজি দিয়ে মাছ বা আলু দিয়ে মুরগি, রাতেও মাছ না হলে মাংস থাকে। তবে যা–ই হোক, তরকারি এক পদেরই হয়। বড় হাঁড়িতে রান্নার পর ঝুড়িতে ভাত থাকে। তিনি শুধু বাটিতে তরকারি উঠিয়ে রেখে দেন। সবাই থালা ধুয়ে ঝুড়ি থেকে নিজের ইচ্ছামতো ভাত আর একটা বাটি নিয়ে বসে পড়েন। তবে যতজন মানুষ থাকে, তাঁর চেয়ে দুটি বাটি বেশি রাখা হয়।
কেন? জানতে চাইলে পাশে বসা তপু নামের একজন বলেন, ‘ধরেন কোনো ভিক্ষুক এল। বাড়ি থেকে কারও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এল বা কখনো ইউনিয়নের কোনো নেতা এল। মোট কথা খাওয়ার সময় যে–ই আসুক, না খেয়ে যেতে দিই না। বাটি বেশি না রাখলে ঘাটতি পড়লে কী হবে বলেন?’
প্রতিদিন খাওয়াকে শ্রমিকেরা বলেন খোরাকি। এ খোরাকির পেছনে জনপ্রতি প্রতিদিন প্রায় ১৫০ টাকা খরচ আছে। মজুরি বাবদ যে টাকা পান, প্রথমে খাবার খরচের টাকা বাদ রেখে তা ভাগ হয়। ওই দিন যতজন কাজ করবেন, তাঁদের মধ্যে ভাগ হবে।
একটা সময় দেশের অন্যতম এ নদীবন্দরে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। এখন অবস্থা স্বাভাবিক হলেও জাহাজ আর তেমন ভেড়ে না। জহুরের কথাতেই উঠে এল সে কথা। বলেন, ‘মারামারি, কাটাকাটি, গোলাগুলির কত গল্প শুনেছি। এখন অবশ্য এসব নেই। এখন জাহাজও ভেড়ে কম। আগে খালাস করার জায়গা পাওয়া যেত না। এখন মাঝেমধ্যে দু–এক সপ্তাহ বসেও থাকা লাগে।’
নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হয় না—এমন প্রশ্নে তিন-চারজন প্রায় একসঙ্গে বলে ওঠেন, হয় না তা নয়। কাজ কমবেশি করা নিয়ে কথা–কাটাকাটি হয়। তবে সন্ধ্যার পর সবাই বসে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা হয়; স্থায়ী হতে দেওয়া হয় না।
দলটির সবচেয়ে সিনিয়র সদস্যদের একজন ইকবাল হালদার। বয়স ৩৭ বছর। ১৬ বছর ধরে এ ঘাটে কাজ করছেন। অভিজ্ঞতা থেকে ইকবাল ঘাট আর কাজ নিয়ে নানা কথা শোনালেন। বলেন, ‘কোন পয়েন্টে কোন জাহাজ ভিড়বে, তা মূলত শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা ঠিক করেন। সাতটি জাহাজ যদি আসে, তাহলে সাতটি পয়েন্টে ভেড়ে। ধরেন, যদি দুটি এল। তখন হয়তো দুই সরদারের লোক মিলেমিশে কাজ করেন, অন্য দলগুলো বসে থাকে। পরে আবার অন্যরা করে।’
আয়ের প্রসঙ্গে ইকবাল বলেন, সব দিন সমান হয় না। ভালো ডেলিভারি দিতে পারলে আয় বেশি। দিনে ৭০০-৮০০ টাকা হয়। খোরাকি বাদে কমবেশি ৫০০ টাকা থাকে। তাঁর কথার মধ্যে লুৎফর রহমান শেখ বলেন, ‘আয়ে সংসার চলে না। গত সপ্তাহে বৃষ্টির জন্যি একটা টাকা বাড়ি নিতি পারিনি। সপ্তাহ শেষে আরও ৫০০ টাকা গায়ে পড়িছে। তারপরও করতি হবে। গ্রামের কাজে বকেয়া পড়ে। এখানে নগদ টাকা পাই। দেনা শোধটা হয়। কিস্তিটা চলে, খাওয়াটা চলে। তবে বেশি কিছু থাকে না।’
এ দলের শ্রমিকেরা অন্য কাজও করেন। ধান কাটেন, মাটির কাজ করেন। তবে স্থায়ী কাজ বলতে এটাই। কারোরই তেমন জমি নেই। হয়তো সামান্য ভিটেমাটি আছে। কেউ কেউ সন্তানদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। বেশির ভাগই কম বয়সে দাদা-নানাও হয়ে গেছেন। তবে তাঁদের মধ্যে একটা মিল আছেই, তা হলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের বোঝা সামলাতে হচ্ছে সবাইকে।
মেস থেকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে ইকবাল হালদার বলেন, ‘আমরা সবাই ভাই এনজিওর ঋণে জড়ানো। চিন্তা ও পরিশ্রমে এ বয়সে চুল–দাড়ি সব পাইকে গেছে। তবে আর দু–চার বছর করে আর করব না। বাজারঘাটে চায়ের দোকান বা কিছু একটা যেন করতে পারি, এ দোয়া কইরেন।’