লবণসহিষ্ণু ফসলে সমৃদ্ধি 

লবণাক্ততা বেশি থাকায় আগে খুলনার কয়রা উপজেলার অনেক জমিতে ফসল আবাদ করা সম্ভব হতো না। এখন লবণসহিষ্ণু ফসলে কৃষকদের সুদিন ফিরেছে।

খুলনার কয়রা উপজেলায় লবণসহিষ্ণু জাতের শর্ষেখেত। গত বুধবার উপজেলার উত্তর বেদকাশীর বিলেছবি: প্রথম আলো

খুলনার সর্বদক্ষিণের সুন্দরবনঘেরা উপজেলা কয়রা। মাত্র তিন বছর আগেও অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে কৃষকেরা সেভাবে ফসল উৎপাদন করতে পারতেন না। বর্ষাকালে ধান আবাদই ছিল একমাত্র ভরসা। মিঠাপানির অভাবে বছরের অধিকাংশ সময় ফসলি জমি পতিত থাকত। এলাকার মানুষ জীবিকার জন্য কাজের সন্ধানে শহরে যেতেন। কিন্তু কৃষকদের সেই দুর্দশা এখন আর নেই। কৃষকেরা লবণসহিষ্ণু ফসল আবাদ করে তাঁদের ভাগ্য বদলে ফেলেছেন। ফসল বিক্রি করে তিন বছরের ব্যবধানে তাঁদেরও আয় বেড়েছে কয়েক গুণ।

কয়রার কৃষকেরা বলছেন, সিডর, আইলা, ফণী, বুলবুল, আম্পানসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর লবণসহিষ্ণু ফসল চাষের পদ্ধতি শিখেছেন তাঁরা। বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে প্রশিক্ষণসহ নানা সেবা পাচ্ছেন তাঁরা। লাভের মুখ দেখায় কৃষকেরা বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে ধান, ফল, সবজি, মাছসহ একসঙ্গে অনেক ফসল চাষ করছেন। 

সম্প্রতি উপজেলার ৩ নম্বর কয়রা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বিস্তৃত মাঠজুড়ে বেগুনের চাষ হয়েছে। গাছে গাছে দুলছে বেগুন। মাঠের পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠানেও হয়েছে বেগুনের চাষ। গ্রামের কৃষকেরা জানান, বিভিন্ন জেলার পাইকারেরা এসে তাঁদের কাছ থেকে বেগুন কিনে নিয়ে যান। 

কয়রা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, মাছের ঘের ও পুকুরের ওপর বাঁশ দিয়ে তৈরি করা সারি সারি মাচা। কোনোটিতে বিভিন্ন রকম সবজি, আবার কোনোটিতে লাগানো হচ্ছে নানা জাতের তরমুজ। নিচে এক পাশে ধান আবার আরেক পাশে মাছ চাষ হচ্ছে। এ ছাড়া পতিত জমিতে বিনা চাষে আলু, রসুন, সূর্যমুখী, ভুট্টা চাষ করছেন কৃষকেরা।

কয়রার নাকশা গ্রামে কৃষক আবদুল কাদের। আগে অন্যের জমিতে কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। এখন জমি বর্গা নিয়ে নিজেই নানা ফসল চাষ করছেন। পেয়েছেন সাফল্যও। তিনি জানালেন, ‘আমরা বংশপরম্পরায় কৃষিকাজ করেছি। কিন্তু একসময় লবণাক্ততার কারণে এবং মিঠাপানির অভাবে জমিতে চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যায়। জীবন-জীবিকার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম।’

আবদুল কাদের আরও বলেন, ‘খুলনার ডুমুরিয়ায় মাছ ও সবজির সমন্বিত চাষের খেতে বেশ কয়েক মাস কাজ করি। বাড়ি ফিরে এসে মাছ ও সবজির সমন্বিত চাষ করার পরিকল্পনা থেকে একজনের কাছ থেকে তিন বিঘা জমি ভাড়া নিয়ে চাষাবাদ শুরু করি। প্রথম বছরেই আমার সফলতা দেখে এলাকার অনেকেই এ পেশায় সম্পৃক্ত হয়েছেন।’

কৃষিকাজ করে সফল হওয়া আবদুল কাদের বলেন, ‘আমরা প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছি। নিজে কিছু জমিও কিনতে পেরেছি। এ বছর পাঁচ বিঘা জমিতে মাছ ও সবজি চাষ করেছি। বছরে দেড় লক্ষাধিক টাকা খরচ করে ছয় থেকে সাত লাখ টাকা লাভ পাওয়া যায়। কৃষি অফিস আমাকে পরামর্শ-প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বীজ ও সার দিয়ে সহযোগিতা করে।’

উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কয়রায় মাছ ও সবজির সমন্বিত চাষ ব্যাপক বেড়েছে। চলতি বছ‌রে উপ‌জেলার ১ হাজার ২৭০ হেক্টর জ‌মি‌তে ২৪ হাজার ২৫৯ মে‌ট্রিক টন সব‌জি উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু বেগুনই উৎপাদিত হয়েছে  ২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। এ ছাড়া ১ হাজার ২০০ হেক্টর জ‌মি‌তে ৪৪ হাজার ৫২৮ মে‌ট্রিক টন তরমুজ উৎপাদিত হয়েছে। চলতি অর্থবছ‌রে কয়রায় ৮৮ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী, ৪০ হেক্টরে ভুট্টা, ৪ হাজার ৯২৫ হেক্টরে বোরো ধান,  ১৪৬ হেক্টরে শর্ষে ও  ১৫০ হেক্টর জমিতে মিষ্টি আলু আবাদ করা হয়েছে।

জানা যায়, ২০১৫ সালের দিকে প্রথমবারের মতো কয়রার লবণাক্ত পতিত জমিতে ফসল উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে মাঠে নামে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সরেজমিন গবেষণা বিভাগ। তারা দেখতে পায়, কয়রার অধিকাংশ জমির লবণাক্ততার মাত্রা বেশি। তবে গবেষক ও কৃষকেরা হাল না ছেড়ে গবেষণা চালাতে থাকেন। ২০১৭ সালে সফলতা আসে। ওই সময় উপজেলার পূর্ব মহারাজপুরের লবণাক্ত বিলে পরীক্ষামূলকভাবে ৩৭ জন কৃষক প্রায় ৫০ বিঘা জমিতে ব্রি-৬৭ নামের উচ্চ লবণসহিষ্ণু জাতের ধানের চাষ করেন। বীজ থেকে শুরু করে সার্বিক সহযোগিতা করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়। ভালো ফলাফল পাওয়ার পরবর্তী বছর ওই এলাকার দুই হাজার বিঘার বেশি জমিতে বোরো ধানের চাষ করেন কৃষকেরা। 

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) খুলনা কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. হারুনর রশীদ বলেন, ‘গত তিন বছরে কয়রা উপজেলার লবণাক্ত জমিতে ফসল উৎপাদন বেড়েছে। ইতিমধ্যে আমরা ধান, ডাল, তরমুজ, আলু, ভুট্টা, বার্লি, সূর্যমুখী, শাকসবজিসহ অনেক ফসলের লবণসহিষ্ণু উন্নত জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছি। এসব জাত ও উৎপাদনের প্রযুক্তি উপকূলবর্তী কয়রাসহ অনেক এলাকার কৃষকদের মধ্যে দ্রুত সম্প্রসারণের জন্য কাজ চলছে।’ 

কয়রা উপজেলার শ্রীরামপুর, বামিয়া, খেওনা, বতুলবাজার, ৩ নম্বর কয়রাসহ বেশ কিছু গ্রামে অনেক জমিতে সবজি চাষ করা হয়েছে। এসব গ্রামের কৃষক গোপাল সরদার, আবদুল আজিজ, ইয়াসিনসানাসহ বেশ কয়েকজন বলেন, কৃষিকাজ করে তাঁরা এখন স্বাবলম্বী।