বানাতে চেয়েছিলেন গিটার, হলো রবীন্দ্রনাথের মুখ, সেই শুরু তজুর
ছেলের বয়স তখন দুই থেকে তিন মাস। ইচ্ছা হলো ছেলের জন্য কাঠের টুকরা দিয়ে একটা গিটার বানিয়ে রাখার। পছন্দের কাঠের টুকরাও সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু তখন আর গিটার বানানো হলো না। একজনের কথামতো কাজ করে সেই কাঠের টুকরায় ফুটিয়ে তুললেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখ। সেই যে কাঠ দিয়ে প্রতিকৃতি তৈরির ঘোর তৈরি হয়েছিল সবুজ তজুর (৫৫), আড়াই দশক ধরে সেই ঘোরেই আছেন তিনি।
প্রায় প্রতিদিনই কাঠের সঙ্গে সবুজ তজুর দেখা হয়। হাতুড়ি-বাটালি দিয়ে কাঠের শরীরে চলে কারও মুখ, কারও সম্পূর্ণ প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলার কাজ। কোনো না কোনো বিখ্যাতজনের চেহারা ফুটে ওঠে এসব কাঠে। একইভাবে ফুটিয়ে তোলেন কোনো বন্য প্রাণীকে। গিটারের সূত্র ধরে সেই যে গাছের ডাল, গাছের গোড়া, গাছের টুকরোর সঙ্গে তাঁর এক ভাবজগৎ তৈরি হয়েছিল, সে জগতের সঙ্গে আর ছেদ পড়েনি। এই কাঠের কাজেই তাঁর একমাত্র সুখ। এই শিল্পী সবুজ তজুর বাড়ি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার হরিণছড়ায়।
সবুজ তজু বলেন, এখন থেকে ২৫-২৬ বছর আগের কথা। ছেলের জন্য যখন গিটার বানানোর কাজ শুরু করলে এক চাচাতো ভাই বললেন যে এই কাঠের টুকরা দিয়ে গিটার ভালো হবে না। গিটার বানানোর দরকার নেই। ওই টুকরাকে একটু ঘুরিয়ে দিলে মাথার মতো হয়ে যাবে, নিচের দিকটা হয়ে যাবে দাঁড়ি। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেহারা পাবে। তাঁর কথামতো কাজটা করতে গিয়ে তিনি অবাকই হয়েছেন। তাঁর কাজটি দেখতে অনেকটাই রবীন্দ্রনাথের মুখের মতো হয়ে গেছে।
সবুজ তজু বলেন, ‘তখন কী যে হলো! কী রকম একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। কাঠ দিয়ে কাজ করতে ভালো লাগতে শুরু করে। সেই যে কাঠ দিয়ে কিছু করার আগ্রহ তৈরি হলো, এখনো সেই রকমই কাজ করে চলছি।’ কাঠের শরীরে হাতুড়ি-বাটালিতে টুকটুক করে একের পর এক প্রতিকৃতি আঁকতে লাগলেন। এর মধ্যে কত মানুষ, কত প্রাণীর অবয়ব ফুটিয়ে চলেছেন; তার কোনো হিসাব নেই। এই হাতুড়ি–ছেনি-বাটালির তুলিতে কাঠে ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মা মেরি, রাধা-কৃষ্ণ, যিশু, বনের হরিণ, বাঘ—এমন কত–কী! যখন যা মাথায় আসে, তা–ই ফুটিয়ে তোলেন কাঠে। কখনো কারও চাহিদামতো তৈরি করে দেন। কারও কাছ থেকে তিনি কখনো কাঠের কাজ করাটা শেখেননি, প্রশিক্ষণ নেননি। তবে কারিতাস নামে একটা প্রতিষ্ঠানের নকশাবিদ সুকুমার পাল তাঁকে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন, কাজের ক্ষেত্রে তাঁর ওই পরামর্শটুকু কাজে লাগে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করা তাজুল ইসলাম তাঁকে বিভিন্ন সময় নানাভাবে সহযোগিতা করেন।
স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে সবুজ তজুর সংসার। ছেলেমেয়েরা সবাই পড়াশোনা করছে। মাঝেমধ্যে কিছু শিল্পকর্ম বিক্রি হয়। ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন একেকটি প্রতিকৃতি। কাজের জন্য মাঝেমধ্যে কাঠ কিনতে হয়। এ ছাড়া বনের ভেতর থেকে পরিত্যক্ত কাঠের টুকরা, ডালপালা, গাছের গোড়া সংগ্রহ করে কাজ করেন। তাঁর ভাষায়, ‘যত দিন পারি, এই কাজই করে যাব। এই কাজটাই পারি। এতেই ভালো লাগে। অন্যকিছু করতে আর ভালো লাগে না।’