কক্সবাজারের ৩২ শিশুর মুখে হাসি ফেরালেন চিকিৎসকেরা

টেকনাফের হ্নীলা ফুলেরডেইল গ্রামের নাছিমা আক্তারের কোলে জমজ দুই মেয়ে। জমজ দুই বোনের ঠোঁটকাটার সমস্যা মিটেছে অস্ত্রোপচারের পরছবি: প্রথম আলো

চোখভরা পানি আর মুখে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন নাছিমা আক্তার (২৫)। কোলে ১০ মাস বয়সের দুই যমজ কন্যাসন্তান ফারিয়া ও মারিয়া। জানালেন, ‘জন্মের পর থেকে কাটা ঠোঁট নিয়ে ঠিকমতো খেতে পারত না মেয়েরা। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এক লাখ টাকা চাওয়া হয়। হোপ হাসপাতালে বিনা মূল্যে অস্ত্রোপচারের খবর পেয়ে ছুটে আসি। পাঁচ দিন পর মেয়েদের নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। মায়ের কাছে সুস্থ, স্বাভাবিক সন্তানের মুখ দেখার চেয়ে বড় আনন্দের আর কিছু নেই।’

শুধু নাছিমা আক্তার নন, কক্সবাজারের রামুর চেইন্দা এলাকার হোপ হাসপাতালে (মা ও শিশু) বিনা মূল্যে ঠোঁটকাটা-তালুকাটা অস্ত্রোপচার ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন দুর্গম এলাকার ৩২ জন শিশুর চিকিৎসা দেওয়া হয়। সন্তানেরা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন উদ্বিগ্ন মা-বাবা। গত এপ্রিল মাসে তিন দিনব্যাপী এ চিকিৎসা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা স্মাইল বাংলাদেশ ইউএসএর চিকিৎসক।

টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের ফুলেরডেইল গ্রামের বাসিন্দা নাছিমা আক্তার জানান, তাঁর স্বামী মো. আলম পেশায় টমটমচালক। ১০ মাস আগে তাঁদের দুই যমজ মেয়ে হয়। ঠোঁট কাটা থাকায় ঠিকমতো খেতে পারত না তারা। ছোট বাচ্চারা যেমন শব্দ করে আধো আধো কথা বলে, সেটাও বলতে পারত না। কক্সবাজার শহর ও চট্টগ্রামের তিনটি হাসপাতালে মেয়েদের চিকিৎসার জন্য যান তাঁরা। কিন্তু সেখানে অস্ত্রোপচারের জন্য লাখ টাকা চাওয়া হয়। সামর্থ্য না থাকায় মেয়েদের চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না। এ নিয়ে তাঁদের খুব কষ্ট হতো। গত ১৭ এপ্রিল হোপ হাসপাতালে তাদের বিনা মূল্যে অস্ত্রোপচার হয়। এখন মেয়েরা মা বলে ডাকছে। খুব আনন্দ হচ্ছে তাদের।

একই সময় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে জেলার মহেশখালী উপজেলার জাগিরাঘোনার ১১ মাস বয়সী শিশু সালেহ আহমদ। জন্মের পর থেকে সালেহ কথা বলতে পারত না। খাবার খেতেও সমস্যা হতো। তার মা ফাতেমা বেগম (৩০) বলেন, অস্ত্রোপচারের পাঁচ দিন পর থেকে ছেলে মা ডাকতে শুরু করেছে। এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক। বিনা মূল্যের এই সেবা না পেলে তাঁর ছেলের জীবনটা কেমন হতো, তিনি ভাবতেও পারেন না। তিনি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

তিন দিন ব্যাপী শিশুদের ঠোঁটকাটা-তালুকাটা হোপ ফ্রি সার্জারি ক্যাম্পে অস্ত্রোপচারের জন্য মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ, রামুসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার ৬৩ শিশুকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ৩২ শিশুকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বয়স ও ওজন কম থাকায় অপর ৩১ শিশুর অস্ত্রোপচার সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে তাদের বিনা মূল্যে অস্ত্রোপচার করে দেওয়া হবে। গত ৯ বছরে এই হাসপাতালে আরও ৬৮৪ ঠোঁট কাটা-তালুকাটা শিশুর বিনা মূল্যে অস্ত্রোপচার করা হয়। সবাই এখন স্বাভাবিক জীবন কাটাচ্ছে বলে জানান হোপ হাসপাতালের কান্ট্রি ডিরেক্টর কে এম জাহিদুজ্জামান।

কে এম জাহিদুজ্জামান আরও বলেন, সময়মতো অস্ত্রোপচার না করালে ঠোঁট কাটা-তালুকাটা শিশু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের সমস্যায় ভুগতে থাকে। ঠিকমতো খেতে পারে না, খাওয়াতে গেলে খাবার নাকে ঢুকে যায়, শ্বাসনালির প্রদাহ হয় ঘন ঘন। এ ছাড়া শিশু অপুষ্টিতে ভোগে, কানে শোনার সমস্যাও দেখা দেয়। ঠোঁটকাটা যদি ওপরের মাড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, তাহলে দাঁতেরও সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসবের কারণে শিশুরা কথা বলতে বা শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না ঠিকমতো। শিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হোপ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিনা মূল্যে ঠোঁটকাটা-তালুকাটা চিকিৎসা ক্যাম্প চালু রেখেছে। 

শিশুদের অস্ত্রোপচারের কাজ চালান যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ২০ জনের একটি চিকিৎসক দল। দলের নেতৃত্ব দেন স্মাইল বাংলাদেশ ইউএসএর প্রধান শহীদ আর আজিজ। তিনি বলেন, ঠোঁটের ওপরের অংশ এবং মুখের ভেতরের তালুতে যদি দৃশ্যমান কোনো ত্রুটি দেখা দেয়, তাকেই ঠোঁটকাটা অথবা তালুকাটা বলে। মায়ের গর্ভে শিশুর মুখের গড়ন অসম্পূর্ণভাবে গঠিত হলে জন্মের পর এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশে অনেক শিশু ঠোঁটকাটা-তালুকাটা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।

২০০৫ সালে রামুর চেইন্দা এলাকায় ৬০ শয্যার হোপ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে গর্ভবতী নারী ও শিশুদের সেবায় ভূমিকা রাখায় গত বছর ইন্টারন্যাশনাল হসপিটাল ফেডারেশনের (আইএইচএফ) সেরা হাসপাতালের স্বীকৃতি পেয়েছে হাসপাতালটি। গত বছরের ২৭ অক্টোবর প্রথম আলোতে ‘জরুরি পরিস্থিতিতে মানসম্পন্ন সেবায় সেরা হাসপাতাল কক্সবাজারের হোপ’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।