সৌদি আরবে প্রবাসীর মৃত্যু: ‘তিন ছেলে এখনো জানে না বাবা নেই’
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১০টার দিকে সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন নুরুল আলম। তিনি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার আধুনগর ইউনিয়নের আকবরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর মৃত্যুর খবরে পুরো এলাকাতেই এখন শোকের ছায়া। তিন সন্তান এখনো জানে না তাদের বাবা নেই।
মাধ্যমিকের পরপরই জীবিকার টানে সৌদি আরব পাড়ি দেন নুরুল আলম (৩৮)। পরিবারের অভাব ঘোচাতে ১৮ বছর আগেই শুরু করেছিলেন সংগ্রাম। সেলাইয়ের কাজ শিখে দেশটির আসির প্রদেশের আবহা শহরের মাহাইল এলাকায় নিজেই শুরু করেন ব্যবসা। ধীরে ধীরে স্বাবলম্বীও হয়েছিলেন তিনি। তবে সেই নুরুল আলম আর নেই।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১০টার দিকে সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন নুরুল আলম। তিনি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার আধুনগর ইউনিয়নের আকবরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। উপজেলা সদর থেকে লোহাগাড়া সড়ক ধরে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে আকবরপাড়া জামে মসজিদের পাশেই তাঁদের বাড়ি।
গতকাল শনিবার দুপুরে বাড়ির উঠানে কথা হয় নিকটাত্মীয় মোরশেদ আলমের সঙ্গে। তিনি জানান, দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে নুরুল আলম বড়। আর্থিক টানাপোড়নের কারণে মাধ্যমিক (এসএসসি) পাসের পর কলেজে ভর্তি হতে পারেননি তিনি। সৌদি আরবে গিয়ে প্রথমে সেলাইয়ের কাজ শেখেন, এরপর প্রায় ১০ বছর একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কঠোর পরিশ্রমে সঞ্চিত টাকায় আট বছর আগে মাহাইল এলাকায় কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন তিনি। নিজের মাইক্রোবাস চালিয়ে দোকানে দোকানে কাপড় পৌঁছে দিতেন। বৃহস্পতিবার রাতে ডেলিভারি শেষে বাসায় ফেরার পথে মালবাহী লরির সঙ্গে সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।
পরিবারের বরাতে জানা যায়, নিজের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ার পর থেকেই পরিবারের হাল ধরেন নুরুল আলম। ১০ বছর আগে ছোট ভাই নুরুন্নবীকেও সৌদি আরব নিয়ে যান তিনি। এরপর তাঁকেও স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেছেন। চলতি বছর ধুমধাম করে ছোট বোনের বিয়েও দিয়েছেন। এ সময় নুরুল আলমও দেশে এসেছিলেন। মাত্র ১১ দিন আগে নিজের মা ও খালাকে ওমরাহ করাতে সৌদি আরব নেওয়ারও ব্যবস্থা করেন তিনি। তাঁরা দুজন এখনো সৌদি আরব রয়েছেন। মাকে নিজের গাড়িতে করে সৌদি আরব ঘুরে দেখাবেন—এমন কথাও দিয়েছিলেন। তবে সে কথা আর রাখা হলো না।
তিনটা ছোট ছেলে আছে, স্ত্রীও সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তার অবুঝ বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে মনটা ছটফট করছে।নিহত নুরুল আমিনের বাবা সালে আহমদ।
নুরুল আলমের তিন ছেলে রয়েছে। গতকাল দেখা যায়, তারা তিনজনই বাড়ির পাশে ক্রিকেট খেলছে। তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে নওশাদ আবরারের বয়স ১১, মেজ ছেলে নওয়াজ আববারের বয়স ৬ আর ছোট ছেলে নাওহাজ আবরারের বয়স ৪ বছর। তবে বাবা আর নেই—এ কথা তাদের কাউকে জানানো হয়নি। তবে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া নওশাদ বাড়িতে মানুষের ভিড় দেখে হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পারছে।
জানতে চাইলে নওশাদ প্রথম আলোকে বলে, ‘বুধবার রাতে বাবার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল। বলেছিল ভালো করে পড়াশোনা করতে। ১০ দিন পর রেজাল্ট দেবে। ভালো ফল হলে ল্যাপটপ কিনে দেবে।’
‘ছেলের লাশটা একবার দেখতে চাই’
আধা পাকা ঘরের বারান্দায় বসে কাগজপত্র ঘাঁটছিলেন নুরুল আলমের বাবা সালে আহমদ (৬৮)। পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, আদরের ছেলের লাশ দেশে আনার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দ্রুত পাঠানোর তোড়জোড় করছেন তিনি। ছেলের লাশটা যেন অন্তত একবার দেখতে পারেন—এটিই তাঁর চাওয়া। আত্মীয়স্বজনও বাড়িতে ভিড় করছেন লাশ কবে ফিরছে, এ তথ্য জানতে। তবে ঠিক কবে লাশ দেশে আসবে, তা এখনো সবার অজানা।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সালে আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবারের সবার কথা চিন্তা করে আমার ছেলেটা নিজের জন্য কিছুই করতে পারেনি। পাশের জমিটা কিনেছিল, সেখানে একটা সুন্দর ঘর করার ইচ্ছা ছিল। তিনটা ছোট ছেলে আছে, স্ত্রীও সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। রমজানে দেশে এসে অনাগত সন্তানটাকে দেখবে বলেছিল। এইবার যাওয়ার সময় আমাকেও ওমরাহ করতে নিয়ে যাবে বলেছিল। তার অবুঝ বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে মনটা ছটফট করছে।’
স্বামীহারা নওরিন আক্তার বাক্রুদ্ধ। প্রায়ই তিনি অচেতন হচ্ছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি শুধু চান স্বামীর লাশ দ্রুত দেশে আসুক। গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হোক, যেন সন্তানেরা অন্তত বাবার কবর দেখে বড় হতে পারে, নিয়মিত জিয়ারত করতে পারে।
জানতে চাইলে আধুনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন বলেন, নুরুল আলমের লাশ দেশে আনতে ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা করা হচ্ছে।