‘কবিরাজবাড়ি’তে ঝাড়ফুঁকে চলে হাড়ভাঙার ‘চিকিৎসা’

একটি বাড়িতে ঝুলছে ‘কবিরাজবাড়ি’ লেখা সাইনবোর্ড। সিরাজগঞ্জের বেলকুচির আজুগড়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

সিরাজগঞ্জের বেলকুচির আজুগড়া গ্রামের পাঁচটি বাড়িতে ঝুলছে ‘কবিরাজবাড়ি’ লেখা সাইনবোর্ড। এখানে ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও হাড়ভাঙা রোগীদের ‘চিকিৎসা’ চলে। একসময় দিনমজুর হিসেবে কাজ করা ব্যক্তিরা এমন ‘চিকিৎসাকেন্দ্র’ খুলে বসেছেন বলে স্থানীয় মানুষের অভিযোগ। কবিরাজদের দাবি, তাঁদের চিকিৎসায় রোগীরা সুস্থ হচ্ছেন। আর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, এটা অপচিকিৎসা।

এসব কবিরাজবাড়ি রোগী আর তাঁদের স্বজনে সরগরম। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীরা ‘চিকিৎসা’ নিতে আসেন। এখানকার কবিরাজেরা ‘চিকিৎসা’ দিতে অন্যান্য এলাকায় যান।

গ্রামের একটি কবিরাজবাড়িতে আছেন পাবনা থেকে আসা জহুরুল ইসলাম (৩৫)। তিনি বলেন, ১৪ দিন ধরে মাকে এখানে চিকিৎসা করাচ্ছেন। তাঁর একটি হাত বাঁশের কাঠি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সবার কাছে শুনেছেন যে এখানকার চিকিৎসা ভালো, তাই এসেছেন। তাঁর মায়ের হাতের অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হয়েছে বলে দাবি তাঁর। সব মিলিয়ে তাঁদের কাছ থেকে নেওয়া হবে ১৮ হাজার টাকা।

পাশের গ্রাম গোপালপুর থেকে শিশু গোপাল চন্দ্রকে (৭) নিয়ে এসেছেন তার বাবা, মা ও বড় ভাই। শিশুটির বাবা শিবেন চন্দ্র বলেন, স্কুলে খেলতে গিয়ে গোপালের হাত ভেঙে গেছে। সাত দিন হলো এখানে এসেছেন। ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

স্থানীয় একাধিক সূত্রের দাবি, কবিরাজেরা ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে হাতুড়ে চিকিৎসা করে থাকেন। সাধারণ হাত ভাঙার চিকিৎসায় কবিরাজকে দিতে হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাগে। প্রতিটি বাড়িতে রোগীদের থাকার জন্য একাধিক ঘর আছে। তবে খাবারের ব্যবস্থা নিজেদের করতে হয়। বর্ষাকালে রোগীর সংখ্যা বাড়ে বলে তাঁদের তথ্য।

এগুলোকে অপচিকিৎসা বললেন সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ ও সার্জন রাজিব মাহমুদ।

একজন হাতভাঙা রোগীর চিকিৎসা করছেন কবিরাজ আবদুল হাই। সিরাজগঞ্জের বেলকুচির আজুগড়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কবিরাজদের ব্যান্ডেজের কারণে অনেক ক্ষেত্রে পচন ধরে যায়। পরে হাত বা পা কেটে ফেলতে হয়। আবার অনেক সময় ভুল ব্যান্ডেজের কারণে হাত বা পা কার্যকারিতা হারায়। অনুমাননির্ভর এ চিকিৎসায় অনেক ক্ষেত্রে ভাঙা হাড় ঠিকমতো জোড়া লাগে না। রোগী সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়। এসব কবিরাজ কীভাবে দিনের পর দিন অনুমোদনহীন চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন, তা প্রশাসনের খতিয়ে দেখা উচিত। এসব ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পেছনে প্রতারক ও দালাল চক্র কাজ করে। এ ছাড়া মানুষের অজ্ঞতা ও অন্ধ বিশ্বাসও দায়ী।

সম্প্রতি ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের সঙ্গেই একে একে পাঁচটি বাড়ির সামনে ‘কবিরাজবাড়ি’ সাইনবোর্ড লাগানো। এসব সাইনবোর্ডের নিচে কবিরাজদের নাম লেখা। একটি বাড়িতে ৮০ বছর বয়সী কবিরাজ আবদুল হাইকে দেখা যায়, ঝাড়ফুঁক দিয়ে একজন হাতভাঙা রোগীর চিকিৎসা করছিলেন তিনি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দেশের ৬০ জেলা থেকেই তাঁর কাছে রোগী আসেন। তাঁর বাবা জনাব আলী ও মা জহুরা খাতুনের কাছ থেকে পক্ষাঘাত ও হাড়ভাঙার কবিরাজি চিকিৎসা শিখেছেন। অন্যরাও একইভাবে বংশপরম্পরায় এ পেশায় এসেছেন।

একবার পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হওয়ার পর খুব ঝামেলায় পড়েছিলেন জানিয়ে আবদুল হাই বলেন, এরপর ঢাকা থেকে তিনি আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাঁর দাবি, তিনি মানুষের সেবা করছেন। কারও কোনো ক্ষতি করছেন না। গ্রামে তাঁর মতো অন্য যাঁরা আছেন, তাঁরা মানবসেবা করছেন। বাবার মৃত্যুর পর তাঁরা দুই ভাই ও এক বোন আলাদাভাবে কবিরাজি করেন। এখন ভাতিজারাও এ পেশায় এসেছেন।

এখান থেকে ‘চিকিৎসা’ নেওয়া উপজেলার তামাই পশ্চিম পাড়া গ্রামের মাসুদ রানা বলেন, গাছ কাটতে গিয়ে তাঁর পায়ের হাড় ভেঙে যায়। কবিরাজি চিকিৎসায় হাড় জোড়া লেগেছে। কিন্তু খানিকটাই ছোট হয়ে গেছে পা। এ কারণে তাঁর হাঁটতে কষ্ট হয়।

গ্রামের মোড়ে পল্লিচিকিৎসক ইউসুব আলীর ওষুধের দোকান। তিনি বলেন, মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসকেরা বলবেন, এটা অপচিকিৎসা। আর যাঁরা এখান থেকে সুস্থ হয়ে ফিরছেন, তাঁরা বলবেন, এখানে উপকার পাচ্ছেন। এখন কারটা মানবেন? পঙ্গু হাসপাতালে পা কেটে ফেলতে বলা হয়েছে, এমন অনেক রোগী এখানে এসেছেন বলে দাবি তাঁর।

সিরাজগঞ্জের সিভিল সার্জন রামপদ রায় প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ওই গ্রামে যাবেন। এভাবে লাইসেন্স ছাড়া চিকিৎসা দেওয়া যায় না। এ অপচিকিৎসায় অনেক সাধারণ মানুষকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হচ্ছে।