‘আতঙ্কের মে’তে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ নিয়ে উপকূলে শঙ্কা
প্রায় ১০ কিলোমিটার বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ধস দেখা দিয়েছে। ঝড় এলে নদীর পানি বেড়ে এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা।
উপকূলবাসীর কাছে আতঙ্কের মাস মে। প্রতিবছর এই মাসের শেষে সুন্দরবন উপকূলে আছড়ে পড়ে আইলা, ফণী, ইয়াস ও আম্পানের মতো প্রলয়ংকরী সব ঘূর্ণিঝড়। দুর্যোগ মৌসুম শুরু হলেই ভাঙন ধরে সুন্দরবন–সংলগ্ন উপকূলীয় উপজেলা কয়রার বিভিন্ন বেড়িবাঁধে। প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। ইতিমধ্যে কয়রার শাকবাড়িয়া ও কপোতাক্ষ নদের প্রায় ১০ কিলোমিটার বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ধস দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন উপকূলের তিন লাখ বাসিন্দা।
উপকূলের বাসিন্দারা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের বিষয়টি জনপ্রতিনিধিদের জানালেও তাঁরা শুধু আশ্বাস দেন। বাঁধ মেরামতে কেউ উদ্যোগ নেন না। বর্ষায় যখন জোয়ারের পানি বাঁধ উপচে পড়ার উপক্রম হয়, তখন মেরামতে উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। এতে একদিকে কাজের ব্যয় বাড়ে, অন্যদিকে কাজ হয় নিম্নমানের। প্রায় সময় বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়। জনপ্রতিনিধিদের দাবি, পরিকল্পিত ও স্থায়ী বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় প্রতিবছর ভাঙন দেখা দেয়। এ জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের গাফিলতিই দায়ী।
পাউবোর খুলনার উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মশিউল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, পাউবো ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের তালিকা করে বরাদ্দের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। কিন্তু তা অনুমোদন হতে সময় লাগে। বর্তমানে কয়রার উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে বাঁধ নির্মাণসহ প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান। প্রকল্প শেষ হলে ৩১ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিমুক্ত হবে। পরে ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে কাজ করা হবে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্র জানায়, গত এক দশকে মে মাসে আটটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ৪ মে ঘূর্ণিঝড় ফণী, ২০২০ সালের ২০ মে আম্পান, ২০২১ সালের ২৬ মে ইয়াসে সুন্দরবন-সংলগ্ন উপকূলীয় উপজেলা কয়রায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ ছাড়া ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০১৬ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে ঘূর্ণিঝড় মোরা ও ২০১৩ সালের ১৬ মে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন আঘাত হানে।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার ক্ষত এখনো দগদগে। এতকাল যত দুর্যোগ এসেছে, অধিকাংশই মে মাসে। এ জন্য মে মাস এলেই আতঙ্কে থাকেন উপকূলবাসী। ঘূর্ণিঝড় না হলেও এর প্রভাবে নদীর পানি বেড়ে বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়।
এলাকাবাসী, জনপ্রতিনিধি ও পাউবোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়রা সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে গোবরা পর্যন্ত প্রায় ১ কিলোমিটার, হরিণখোলা-ঘাটাখালি এলাকায় ১ কিলোমিটার, ৬ নম্বর কয়রা এলাকায় ৬০০ মিটার, ২ নম্বর কয়রা এলাকায় ৫০০ মিটার, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ি-দশহালিয়া এলাকায় ২ কিলোমিটার, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাটকাটা থেকে শাকবাড়িয়া গ্রাম পর্যন্ত ১ কিলোমিটার, কাশিরহাটখোলা থেকে কাটমারচর পর্যন্ত ৭০০ মিটার, পাথরখালী এলাকায় ৬০০ মিটার ও মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, নয়ানি, শাপলা স্কুল, তেঁতুলতলার চর ও চৌকুনি এলাকায় ৩ কিলোমিটারের মতো বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এসব এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীর পানি বাড়লে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গত সোমবার সরেজমিনে দেখা গেছে, মদিনাবাদ লঞ্চঘাট এলাকায় ১ কিলোমিটার বাঁধ ধসে সরু হয়ে গেছে। চর ভেঙে একেবারে বাঁধের পাশ দিয়ে স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। কয়েক জায়গায় নিচু বাঁধের ওপর মাটির দেয়াল তৈরি করে জোয়ারের পানি ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। একই অবস্থা গড়িয়াবাড়ি গ্রাম, ৪ নম্বর কয়রা, পাথরখালী ও মহেশ্বরীপুর এলাকায়। তীব্র ভাঙনে সিসি ব্লক সরে গিয়ে হুমকিতে আছে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের কাটকাটা এলাকার বাঁধ। মহারাজপুর ইউনিয়নের সুতিয়া বাজার এলাকায় শাকবাড়িয়া নদীর জলকপাটটি নষ্ট হওয়ার উপক্রম। জলকপাটের দুই পাশের মাটি দেবে পানি ঢুকছে লোকালয়ে।
কয়রা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান কমলেশ কুমার বলেন, স্থায়ী সমাধান না হলে কয়রাবাসী আবার আইলা, আম্পান, ইয়াসের মতো বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে পারে। তিনি পাকা ব্লক ফেলে বাঁধের উচ্চতা বাড়ানোর তাগিদ দেন।
সদর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মাসুম বিল্লাহ বলেন, বড় জোয়ারে বাঁধ ভাঙলে গোটা ইউনিয়ন তলিয়ে যাবে। এ নিয়ে পাউবোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার কথা হয়েছে। কিন্তু তাঁরা টালবাহানা করে কালক্ষেপণ করছেন।
পাউবোর খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আপাতত কয়রার ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের তালিকা করা হয়েছে। কিছু এলাকায় সংস্কারকাজও শুরু হয়েছে। বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ না এলে কোনো সমস্যা হবে না। উত্তর ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে বাঁধের মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঝুঁকি কমবে।
কয়রার সুতিয়া বাজারের বাসিন্দা আবু সাঈদ সরদার বলেন, ‘সময়ের কাজ সময়ে করলি আমাগে এত ভুগতি হয় না। গাঙের পানি যখন চরের নিচে থাকে, তখন কারও দেখা পাওয়া যায় না। গাঙের পানি যখন বাঁধের কানায় আইসে ঠেকে, তখন শুরু হয় মিয়া সাহেবগের তোড়জোড়।’