শালিখা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকটে সেবা ব্যাহত

এখানে চিকিৎসকের ২৮টি পদের মধ্যে ১৭টিই শূন্য। এক্স-রে যন্ত্রটি পাঁচ বছর ধরে বিকল।

মাগুরার শালিখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওয়ার্ডের শয্যায় জায়গা না থাকায় মেঝেতে রেখে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়
ছবি: প্রথম আলো

মাগুরায় ফুটবল খেলতে গিয়ে হাতে আঘাত পাওয়া এক শিক্ষার্থীকে নিয়ে শালিখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসেছিলেন শিক্ষক দেবাশীষ বিশ্বাস। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ওই শিক্ষার্থীকে এক্স-রে করার পরামর্শ দেন। এতেই বাঁধে বিপত্তি। কারণ, এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক্স-রে মেশিনটি পাঁচ বছর ধরে বিকল। ফলে উপায় না পেয়ে শিক্ষার্থীকে নিয়ে এক্স-রে করতে ১০ কিলোমিটার দূরে জেলা সদরে গিয়ে এক্স-রে করাতে হয়। এতে সময় ও অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি ওই শিক্ষক ও রোগীকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক্স-রে যন্ত্র না থাকায় দেবাশীষ বিশ্বাসের মতো অনেক ব্যক্তিকে শালিখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগী নিয়ে এসে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ ছাড়া চিকিৎসক ও কর্মচারীসংকটে এই হাসাপাতালে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। 

মঙ্গলবার শিক্ষক দেবাশীষ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালে এক্স-রে মেশিন নষ্ট থাকায় এখন ১০ কিলোমিটার দূরে আড়পাড়া বাজারে গিয়ে এক্স-রে করে আবার এখানে (হাসপাতালে) ফিরে আসতে হয়েছে। এতে সময় ও অর্থের অপচয় হলো। জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই আরও বেশি কষ্ট হয়।’

এক্স-রে মেশিনটি নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও বিব্রত। এটি ২০১৮ সাল থেকে নষ্ট। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হলেও কোন সমাধান মিলছে না। 

 মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগের সামনে রোগীদের সারি। তাঁরা নিজেদের সমস্যার কথা বলে বিভিন্ন চিকিৎসকের টিকিট নিচ্ছেন। অন্তর্বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, নির্ধারিত বিছানা ছাড়াও মেঝেতে বেশ কয়েকজন রোগী শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালের ভেতর ও বাইরে তুলনামূলকভাবে সাজানো-গোছানো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী জানালেন, সকাল থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। দুপুর ১২টা পর্যন্ত খাওয়ার সুযোগও পাননি।

শালিখা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৮ সালে প্রায় ৬ একর জমির ওপর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১৭ সালের মার্চে হাসপাতালটিকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। বর্তমানে এই হাসপাতালে অন্তর্বিভাগে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৭০ জন রোগী ভর্তি থাকেন। আর বহির্বিভাগে সেবা নেন ৩০০ থেকে ৩৫০ রোগী। এমন পরিস্থিতিতে জনবলসংকটের কারণে সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধিকাংশ পদ খালি থাকায় উন্নত চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এলাকাবাসী।

শালিখা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের জনবল কাঠামো অনুযায়ী চিকিৎসকের পদ আছে ২৮টি। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ১১ চিকিৎসক। তাঁরা হলেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, একজন জুনিয়র কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেসিয়া), পাঁচজন চিকিৎসা কর্মকর্তা ও চারজন সহকারী সার্জন। এখানে কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞের ৯টি পদ (মেডিসিন, গাইনি, শিশু, অর্থোপেডিকস, কার্ডিওলজি, চক্ষু, চর্ম ও যৌন, ইএনটি ও ডেন্টাল সার্জন) শূন্য আছে।

স্থানীয় বাসিন্দা সরদার ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পদ এখানে বেশির ভাগ সময় শূন্য থাকে। মাঝেমধ্যে চিকিৎসকদের পদায়ন হলেও তাঁরা দু–তিন মাসের বেশি থাকেন না। সবাই শহরমুখী। যে কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

 উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে দ্বিতীয় শ্রেণির ৩২টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ২৬ জন। এখানে তৃতীয় শ্রেণীর ৭০টি পদের বিপরীতে ৩৯ ও চতুর্থ শ্রেণির ২১টি পদের মধ্যে ১৯টি শূন্য। 

জানতে চাইলে শালিখা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সাইমুন নিছা প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘ ১৫ বছর পর গত বছর থেকে হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটর চালু হয়েছে। গত এক বছরে হাসপাতালে অন্তত ৩৩টি অপারেশন হয়েছে। একই সময়ে ছয় শতাধিক স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনসহ হাসপাতালে অন্যান্য প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষাও হচ্ছে। সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স সেবা চালু আছে। তবে জনবলসংকটের কারণে আমাদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়। জনবলসংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’

হাসপাতালে কর্মরত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চতুর্থ শ্রেণির জনবলসংকট মোকাবিলায় এখানে আউটসোর্সিংয়ের (চুক্তি ভিত্তিক) মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ১১ জন কর্মী কাজ করছেন। তবে তাঁরা কেউই গত ১৩ মাস কোনো বেতন পাননি। তাঁদের একজন পরিচয় গোপন রাখার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে পুরো জেলায় ৪২ জন নিয়োগ পাই। তবে গত ১৩ মাস আমরা কোনো বেতন পাই না। পরিবার–পরিজন নিয়ে খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছি। জানি না কবে বেতন পাব।’

মাগুরার সিভিল সার্জন শহীদুল্লাহ দেওয়ান  বলেন, ‘আমরা নিয়মিতভাবে এসব সংকটের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আসছি। প্রথম শ্রেণির (চিকিৎসক) জনবল নিয়োগ করা হয় মন্ত্রণালয় থেকে। তৃতীয় শ্রেণীর জনবল নিয়োগের বিষয়টি বিভাগীয় পর্যায়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আর চতুর্থ শ্রেণীর জনবলসংকট মোকাবিলা করতে আমাদের আউটসোর্সিং করতে হয়। কিন্তু গত বছর ওই কর্মীদের (যাঁরা বেতন পাচ্ছেন না) চুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে নবায়ন করা হয়নি। এ কারণে তাঁরা বেতন পাননি।’