ঈদের দ্বিতীয় দিনে কক্সবাজার সৈকত আবার সরব

কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড়। আজ শুক্রবার বিকেলে সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে
ছবি: প্রথম আলো

কয়েক দিন আগেও বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার ছিল অনেকটা ফাঁকা। ছিল না কোনো কোলাহল, হই–হুল্লোড়। কিন্তু ঈদের দ্বিতীয় দিনে বদলে গেছে সেই দৃশ্য। সাগরের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে পর্যটকদের ভিড় বেড়েছে। প্রচণ্ড গরমে শরীর জুড়িয়ে নিতে অনেকেই নেমে পড়েছেন সাগরের পানিতে।

ঈদের দ্বিতীয় দিন আজ শুক্রবার সৈকতে এসেছেন অন্তত ৬০ হাজার পর্যটক। সাগরে স্থানীয় আরও ৪০-৫০ হাজার মানুষ নামেন। সব মিলিয়ে আজ সাগরের লোনাজলে নেমে গোসল করেন প্রায় এক লাখ মানুষ।

সৈকতে ঘোরাঘুরি শেষে বিপুলসংখ্যক পর্যটক ছুটছেন কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ, দরিয়ানগর, হিমছড়ির ঝরনা, পাথুরে সৈকত ইনানী ও পাটোয়ারটেক, টেকনাফ সৈকত, মাথিনকূপ, রামুর বৌদ্ধপল্লি, চকরিয়ার ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক ও মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির। ঈদের তৃতীয় দিন আগামীকাল শনিবার সৈকত ভ্রমণে আরও অন্তত এক লাখ পর্যটক আসবেন বলে আশা করছেন কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলের মালিকেরা।

হোটেলমালিকেরা বলেন, ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ঈদের ছুটির চার দিনে কক্সবাজার সৈকত ভ্রমণ করবেন অন্তত চার লাখ পর্যটক। তখন হোটেল–রেস্তোরাঁসহ পর্যটন–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অন্তত ৭০০ কোটি টাকার ব্যবসা হতে পারে। শুক্রবার সকাল থেকে সৈকতের আশপাশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও খাবারের দোকানে বিক্রি বেড়েছে। ইতিমধ্যে শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস, রিসোর্ট ও কটেজের ৯০ শতাংশ কক্ষ অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। রমজানের এক মাস ভ্রমণে আসা পর্যটকদের হোটেলকক্ষ ভাড়ার বিপরীতে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হলেও ঈদের ছুটিতে যাঁরা ভ্রমণে আসছেন, তাঁদের কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। পাঁচ শতাধিক হোটেল, গেস্টহাউসে দৈনিক ধারণক্ষমতা ১ লাখ ২৮ হাজার।

কক্সবাজার হোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার শহরে দেড় হাজারের মতো পর্যটক অবস্থান করেন। ঈদের দ্বিতীয় দিন আজ শুক্রবার সকাল থেকে পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সৈকত ভ্রমণে এসেছেন অন্তত ৬০ হাজার পর্যটক। আগামীকাল শনিবার পাঁচ শতাধিক হোটেলের শতভাগ কক্ষ বুকিং হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ওই দিন সৈকতে নামবেন আরও এক লাখ বেশি পর্যটক। পরের দিন রোববারও এক লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটবে। সব মিলিয়ে ঈদের ছুটির চার দিনে সৈকত ভ্রমণে আসবেন চার লাখের বেশি পর্যটক।

লোনাজলে গোসল করছেন পর্যটকেরা
আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টায় সৈকতে সুগন্ধা পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে, পাঁচ থেকে ছয় হাজার পর্যটক সমুদ্রের কোমরসমান লোনাজলে নেমে শরীর ভেজাচ্ছেন। কেউ দ্রুতগতির জলযান জেডক্সিতে চড়ে গভীর সমুদ্রে চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ টিউবে গা ভাসিয়ে সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টা করছেন।

কক্সবাজার সৈকতে শুক্রবার সকাল থেকে পর্যটকদের ভিড় বাড়তে থাকে। সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে
ছবি: প্রথম আলো

স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সৈকতে গোসলে নামেন ঢাকার রমনা এলাকার ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফা। তারপর বালুচরে উঠে এসে কিটকটে (চেয়ার-ছাতা) বসে সমুদ্রের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করেন। গোলাম মোস্তফা (৫২) বলেন, ‘প্রচণ্ড গরমে সমুদ্রের লোনাজলে শরীর ভেজানোর মজাই আলাদা। পানিতে ভেসে ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালি দারুণ আনন্দের।’ সকালে উড়োজাহাজে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌঁছে সৈকত তীরের একটি তারকা হোটেলে ওঠেন গোলাম মোস্তফা। তারপর দ্রুত সৈকতে নেমে পড়েন। আগামীকাল সকালে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে ঘুরে বেড়াবেন। রোববার দুপুরে উড়োজাহাজে ঢাকায় ফিরে যাবেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, সুগন্ধা পয়েন্টের পাশাপাশি উত্তর দিকের সিগাল, লাবণী এবং দক্ষিণ দিকের কলাতলীর চার কিলোমিটারের সৈকতেও মানুষ গিজ গিজ করছে। সমুদ্রে গোসলের পাশাপাশি পর্যটকেরা বালুচরে ঘোড়ার পিঠে চড়ে কিংবা বিচবাইকে উঠে সৈকতের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মুঠোফোনে ছবি তুলছেন ইচ্ছেমতো। অনেকে ভিডিও চিত্র ধারণ করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে।

সমুদ্রে গোসলে নেমে নিখোঁজ পর্যটকদের উদ্ধারে সৈকতে তৎপর রয়েছে বেসরকারি লাইফগার্ড প্রতিষ্ঠান সি সেফ–এর ২৬ জন কর্মী। বিপুলসংখ্যক মানুষকে সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জানিয়ে সি সেফ লাইফগার্ডের সুপারভাইজার সিফাত সাইফুল্লাহ বলেন, ‘আজ শুক্রবার সকাল থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সৈকতে নেমেছেন অন্তত এক লাখ মানুষ। এর মধ্যে অন্তত ৬০ হাজার পর্যটক, বাকিরা স্থানীয়। কমবেশি সবাই সমুদ্রের লোনাজলে শরীর ভেজালেও দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে ঢেউয়ের ধাক্কায় কয়েকজন কিশোর-তরুণ গভীর সমুদ্রের দিকে ভেসে যাওয়ার সময় লাইফগার্ডের কর্মীরা তাঁদের উদ্ধার করেন।

ব্যবসা-বাণিজ্যে চাঙাভাব
আজ সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সৈকতের ৫০টির বেশি হোটেল, রিসোর্ট ও গেস্টহাউসে ৮০ শতাংশ কক্ষে অতিথি উঠেছেন। অবশিষ্ট কক্ষগুলোও পরের দিন শনিবার পূর্ণ হয়ে যাবে।

সৈকতের পাশে পাঁচ তারকা হোটেল সিগাল, ওশান প্যারাডাইস, সায়মান বিচ রিসোর্ট, হোটেল কক্স টুডে, হোটেল কল্লোল, মারমেইড বিচ রিসোর্টসহ কলাতলীর অন্তত ৬০টি হোটেল, গেস্টহাউস, রিসোর্ট ও কটেজে ৮০-৯০ শতাংশ কক্ষ শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত বুকিং দেওয়া আছে।

হোটেল সিগালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ ইমরুল ইসলাম ছিদ্দিকী বলেন, রোজার মাসে অধিকাংশ কক্ষ খালি পড়ে ছিল। ঈদের দ্বিতীয় দিন থেকে টানা কয়েক দিন অতিথিতে ভরপুর থাকবে হোটেল। এই হোটেলে মোট কক্ষ আছে ১৭৯টি।

কক্সবাজার রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম বলেন, শনিবার দুপুরের আগেই রোজার মাসে বন্ধ থাকা পাঁচ শতাধিক রেস্তোরাঁ খোলা হয়েছে। হাজার হাজার পর্যটক রেস্তোরাঁয় সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবার সেরেছেন। সৈকত ভ্রমণে আসা পর্যটকদের কাছ থেকে খাবারের অতিরিক্ত মূল্য আদায় হচ্ছে কি না, তা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। খাবার টেবিলে মূল্যতালিকা রাখা থাকে। পর্যটকেরা তালিকা দেখেই যেন খাবারের ফরমাশ দেন।

কক্সবাজার হোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ বলেন, এবারের ঈদের ছুটিতে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের কক্ষভাড়ার বিপরীতে ছাড় দেওয়া না হলেও নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হচ্ছে কি না, তা সমিতির পক্ষ থেকে কঠোরভাবে তদারকি করা হচ্ছে।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, পর্যটকের আগমনের রেস্তোরাঁ, শুঁটকি, শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি করা পণ্যের ব্যবসা চাঙা হয়ে উঠেছে। এবারের ঈদের ছুটির প্রথম পাঁচ দিনে সৈকতে চার লাখের বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটতে পারে। এতে হোটেল, গেস্টহাউস, রেস্তোরাঁসহ পর্যটন–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতে ৬০০-৭০০ কোটি টাকার ব্যবসা হতে পারে। আগের বছর ছয় লাখ পর্যটক আসায় প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ব্যবসা হয়েছিল।

জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ভ্রমণে আসা পর্যটকের সার্বিক নিরাপত্তা এবং দুর্ভোগ হয়রানি রোধ, অতিরিক্ত হোটেলভাড়া এবং খাবারের মূল্য বাড়িয়ে আদায় হচ্ছে কি না, তা তদারকির জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামানো হয়েছে। অভিযোগ জানানোর জন্য সৈকত এলাকায় একাধিক অভিযোগ ও সেবাকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। পর্যটক হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।