বাসায় কার্যালয়, ‘ইচ্ছেমতো’ চলেন বিশ্বনাথ পৌরসভার মেয়র 

ক্ষমতার দাপটে নিজের বাসাতেই পৌরসভার কার্যালয় এনেছেন মেয়র মুহিবুর। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ।

বিশ্বনাথ পৌরসভার মেয়র মুহিবুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

সিলেটের বিশ্বনাথ পৌরসভার মেয়র মুহিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কাউন্সিলরদের মতামত উপেক্ষা করে নিজের ইচ্ছেমতো পৌরসভাকে পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে। মতের বিরুদ্ধে গেলেই তিনি গালাগাল, অশালীন মন্তব্য ও হয়রানি-নিপীড়ন করেন। ক্ষমতার দাপটে নিজের বাসাতেই পৌরসভার অস্থায়ী কার্যালয় বানিয়েছেন। এর বাইরে তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ।

২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বনাথ পৌরসভার প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০২২ সালের ২ নভেম্বর। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচিত হন মুহিবুর। এরপর থেকেই তাঁর দাপটে কেউ টিকতে পারছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।

গত ১৬ এপ্রিল পৌরসভার সাত কাউন্সিলর মেয়র মুহিবুরের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে অনাস্থা প্রস্তাব দেন। এর আগের দিন সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের কাছেও অনাস্থা প্রস্তাব দেন তাঁরা। এ ব্যাপারে বিভাগীয় কমিশনানের কার্যালয় থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

মুহিবুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও তাঁর দলীয় পদ নেই। মেয়র হওয়ার আগে তিনি দুবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।

কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে বাসায় মেয়র

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, বিশ্বনাথ পৌরসভার অস্থায়ী কার্যালয়টি তালাবদ্ধ। ভবনে পৌরসভার কোনো সাইনবোর্ডও নেই। তবে পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের নতুনবাজার এলাকায় মেয়রের বাসভবনে ঢোকার রাস্তায় গিয়ে দেখা গেল, পৌরসভার বিরোধী মীমাংসা বোর্ডের বিশাল একটি সাইনবোর্ড।

তিনজন কাউন্সিলর প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর মাত্র এক দিন উপজেলা পরিষদের ভেতরে অবস্থিত পৌরসভার অস্থায়ী কার্যালয়ে পরিষদের সভা হয়েছে। এরপর প্রতিটি সভাই মেয়র তাঁর নিজ বাসভবনে করেছেন। কিছুদিন আগে অস্থায়ী কার্যালয়টিতে তালা ঝুলিয়ে মেয়র তাঁর বাসভবনকেই পৌর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছেন। কাউন্সিলররা বাধা দিলেও মেয়র শোনেননি।

এ ব্যাপারে মেয়র মুহিবুর রহমান বলেন, পৌরসভার অস্থায়ী কার্যালয় ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ২০১৪ সালে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছিলেন। বর্ষা মৌসুমে সেখানে সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়, হাঁটুপানিও জমে। তাই সব কাউন্সিলরের মতামতে কার্যালয় তাঁর বাসভবনে নিয়ে আসা হয়েছে। 

প্যানেল মেয়র রফিক হাসান বলেন, শুরু থেকেই মেয়র তাঁর বাসায় পৌরসভার বিরোধ মীমাংসা বোর্ড তৈরি করেছেন। তাই বিচারপ্রত্যাশী নাগরিকদের পৌর কার্যালয়ের বদলে মেয়রের বাসভবনে যেতে হচ্ছে। এ ছাড়া মেয়র পৌর কার্যালয়ে দাপ্তরিক কাজ না করায় নাগরিকদের যেকোনো প্রয়োজনে তাঁর বাসায় যেতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে মেয়র মুহিবুর রহমান বলেন, পৌরসভার অস্থায়ী কার্যালয়ে জায়গা সংকট থাকার কারণেই বিরোধী মীমাংসা বোর্ডটি তাঁর বাসভবনের ভেতরে স্থাপন করেছেন।

পৌরসভার টাকায় বাসার উন্নয়ন

২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পৌরসভার তিনটি রাস্তার উন্নয়ন করা হয়। এতে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৭২৩ টাকা। প্রকল্পের নাম ছিল, ‘৮ নম্বর ওয়ার্ডের জানাইয়া সিতাই মিয়ার বাড়ির সম্মুখ রাস্তা উন্নয়ন, জানাইয়া বাবুল মিয়ার বাড়ির সম্মুখ রাস্তা উন্নয়ন এবং ২ নম্বর ওয়ার্ডের নতুনবাজার হোসাইন ফার্নিচার মার্টের পেছনের রাস্তা উন্নয়ন’। প্রকল্পে তিনটি রাস্তার উন্নয়নের কথা বলা হলেও বেশির ভাগ টাকাই খরচ হয়েছে হোসাইন ফার্নিচার মার্টের পেছনের রাস্তাটি উন্নয়নে। এই রাস্তা হচ্ছে মেয়রের বাসায় ঢোকার রাস্তা। যা মেয়রের ব্যক্তিগত জমিতে অবস্থিত।

টিআর কর্মসূচি তদারকির দায়িত্বে থাকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিআইও প্রজেশ চন্দ্র দাস জানান, পৌর কর্তৃপক্ষ এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। তিনটি রাস্তাতেই সঠিকভাবে কাজ হয়েছে। অবশ্য একটি রাস্তা মেয়রের বাসভবনে ঢোকার জন্য ব্যবহৃত হয় বলে তিনি স্বীকার করেন।

এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা ব্যয়ে মেয়রের বাসভবনের আঙিনায় মানুষের বসার জন্য একটি শেড ও শৌচাগার নির্মাণ এবং সেখানে বৈদ্যুতিক কাজ করেছে পৌর কর্তৃপক্ষ। পৌর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মেয়রের বাসায় বিরোধ নিষ্পত্তি বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। মূলত এ কারণেই তাঁর আঙিনায় ওই প্রকল্প নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে মেয়র মুহিবুর রহমান বলেন, ‘কাজগুলো আমার বাসভবনের উন্নয়নের জন্য করা হয়নি। মূলত আমার বাসায় পৌরসভার বিরোধ মীমাংসা বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। তাই এখানে আসা নাগরিকদের সুষ্ঠু সেবা নিশ্চিত করতেই এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। পরে যদি এখান থেকে এ বোর্ড অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে নিলামের মাধ্যমে শেডসহ যাবতীয় স্থাপনা বিক্রির টাকা পৌর কোষাগারে জমা হবে।’

টাকা তোলা শেষ, হদিস নেই কাজের

পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন রাস্তা এবং ড্রেনের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার বাবদ ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৩০০ টাকা বরাদ্দ হয়। কাউন্সিলর জহুর আলী অভিযোগ করেন, একটি রাস্তা ও একটি ড্রেনে এক দিন করে তিন থেকে চারজন শ্রমিক কেবল কাজ করেছিলেন। এর বাইরে কোনো রাস্তা বা ড্রেন পরিষ্কার না করেই সব টাকা মেয়র তাঁর অনুগত ব্যক্তিদের দিয়ে বিল উত্তোলন করিয়ে আত্মসাৎ করেন। প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটেছে অন্যান্য ওয়ার্ডেও।

একাধিক কাউন্সিলরের অভিযোগ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে মস্তুরা পৌর পশুর হাটে ইটের সলিং করা বাবদ একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। কিছু ইট বিছিয়ে আর বিট বালু ফেলে এ কাজ শেষ করা হয়। এতে বড়জোর ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বাকি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে মেয়র মুহিবুর রহমান বলেন, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার বাবদ কোনো অনিয়ম হয়নি। মস্তুরা পশুর হাটের কাজও সঠিকভাবে হয়েছে। কোথাও কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি।

কাউন্সিলরদের অনাস্থা

পৌরসভার নয়টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচন হয়নি। তাই এ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নেই। এ ছাড়া ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর যুক্তরাজ্যে আছেন। বাকি ১০ কাউন্সিলরের মধ্যে সাতজনই মেয়রের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়েছেন।

লিখিত অভিযোগে কাউন্সিলরা বলেন, মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই কাউন্সিলর ও জনগণের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, স্বজনপ্রীতি, গালাগাল, ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতি করছেন। জনপ্রতি দুই থেকে তিন লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে মাস্টাররোলে নিজের আত্মীয়স্বজনকে নিয়োগ দেন। নামে-বেনামে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে মেয়র বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া দরপত্র আহ্বান ছাড়া পৌরসভার উন্নয়নমূলক কাজ করাচ্ছেন। নিজের পছন্দের ঠিকাদারদের দিয়ে কাজ পরিচালনা করছেন মেয়র। প্রকল্প গ্রহণ না করে ভুয়া চালানের মাধ্যমে তিনি টাকা আত্মসাৎ করছেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়, মেয়র প্রায়ই কাউন্সিলরদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও অমানবিক আচরণ করেন এবং নারী কাউন্সিলরদের নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেন। মেয়রের সার্বিক কর্মকাণ্ডের কারণে গত ৯ এপ্রিল সভা করে কাউন্সিলররা অনাস্থা প্রস্তাব গ্রহণ করেন। 

কাউন্সিলরদের অভিযোগের বিষয়ে মুহিবুর রহমান বলেন, ‘আমি দুর্নীতিকে কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তাঁদের (কাউন্সিলর) দুর্নীতি ও অনিয়মের সুযোগ দিইনি, তাই তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে আমার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব দেন। এতে কাউন্সিলররা যেসব অভিযোগ এনেছেন, একটারও কোনো সত্যতা নেই।’

মেয়র আরও বলেন, ‘সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি। তাই স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটা প্রভাবশালী অংশ আমার বিরুদ্ধে আছে। মূলত তাঁদের কলকাঠিতেই কাউন্সিলররা আমার বিরুদ্ধে কিছু মিথ্যা ও ভুয়া অভিযোগে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছেন।’

এ বিষয়ে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার আবু আহমদ ছিদ্দীকী প্রথম আলোকে বলেন, মেয়রের বিরুদ্ধে কাউন্সিলরদের অনাস্থা প্রস্তাবের কার্যবিবরণী ও আবেদন পেয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত চলছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।