‘বাড়িতে তিনটা টিনের ঘর আছিল। আধা ঘণ্টায় ঘর দুটি নদীতে বিলীন হয়ে গেল। ঘরের জিনিসপত্রও বের করতে পারি নাই। সব নদীতে চলে গেল! তিন দিন আগেও সব ছিল, বসতভিটা হারিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি। বউ-পোলাপান নিয়্যা এখন গ্রামের আরেকজনের বাড়িতে আশ্রয় নিছি।’
নদীতে বিলীন হওয়ার পর অবশিষ্ট ভিটায় দাঁড়িয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার কথাগুলো বলছিলেন বৃদ্ধ বাদল খান (৬৮)। তাঁর বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ধুলশুড়া ইউনিয়নের আবিধারা গ্রামে। নদীভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে পরিবার নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন তিনি।
ঢাকার একটি ছাপাখানায় কাজ করতেন বাদল খান। পাঁচ বছর আগে অবসরে বাড়িতে আসেন। স্ত্রী, পাঁচ ছেলে ও নাতি-নাতনি নিয়ে আট সদস্যের পরিবার তাঁর। তিনি জানান, উপজেলায় পদ্মা নদীর দুর্গম চর আজিনগরে পৈতৃক বসতবাড়ি ছিল তাঁর। প্রায় ৪০ বছর আগে নদীভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে পাশের ধুলশুড়া ইউনিয়নের আবিধারা গ্রামে বসতবাড়ি করেন। তবে সেই বাড়িটিও রক্ষা পেল না। গত সোমবার (২১ আগস্ট) রাত সাড়ে ৯টার দিকে আধা ঘণ্টায় আসবাব, মালামালসহ দুটি ঘর নদীগর্ভে চলে যায়।
শুধু বাদল খানই নন, গত তিন দিনে আবিধারা গ্রামের বেশ কয়েকটি বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। এ গ্রামের ফজল বিশ্বাস, আফজাল বিশ্বাস, বাদল খান, ফাহাদ মোল্লা, শেখ শাহিন, আলেক মিয়া, আলেয়া বেগম, রফিজ মিয়া, আবুল কালামসহ আরও বেশ কয়েকজন বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। অন্যের বাড়িতে বা জায়গায় কোনোরকমে দিন পার করছেন। সহায়-সম্বল হারিয়ে তাঁরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
ধুলশুড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. জায়েদ খান প্রথম আলোকে বলেন, নদীর ভাঙনে ইতিমধ্যে আবিধারা গ্রামের ২৪টি পরিবারের বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে নদীর তীরবর্তী আবিধারা, নীলগ্রাম ও কমলাপুর গ্রামের অর্ধশতাধিক বসতবাড়ি।
গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, আবিধারা গ্রামে নদীভাঙনে বেশ কয়েকটি বসতবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করতে কেউ ঘর সরাচ্ছেন, কেউ গাছ কাটছেন। গ্রামের চর মুকুন্দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক-তৃতীয়াংশ নদীতে ধসে গেছে। স্থানীয় ইটের রাস্তাটির প্রায় ৫০০ গজ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। নদীভাঙন ঠেকাতে সেখানে বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
আবিধারা গ্রামের আলেয়া বেগম (৬৫) বলেন, ‘আমার স্বামী–সন্তান নাই। সাত ডিসিমেল (শতক) বাড়িতে একটা ছাপরা ঘরে থাকতাম। মাইনষের বাড়িতে কাজ করে খাওন জোটে। নদী আমার বাড়িঘর সব নিয়্যা গেল! এহন কই যামু?’
হরিরামপুর উপজেলা নদীভাঙনপ্রবণ এলাকা। ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টি ইউনিয়নই নদীভাঙনের শিকার। এবার ধুলশুড়া ইউনিয়নে ভাঙন দেখা দেয়। পদ্মা নদীতে প্রবল স্রোত এবং অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙন প্রবণতা বেড়েছে। নদীর এই ভাঙন রোধে এলাকাবাসী স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান সাইদুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ধুলশুড়া ইউনিয়নে নদীতে দীর্ঘদিন ধরে শক্তিশালী খননযন্ত্র দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে তা বিক্রি করে আসছেন পাশের ঢাকার দোহার উপজেলার নয়াবাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহীদুর রহমান। এ কারণে নদীভাঙনের প্রবণতা আরও বেড়েছে।
তবে শহীদুর রহমান দাবি করেন, ‘বাঁধের কাজের জন্য আগে দোহারের অংশে নদী থেকে ড্রেজার (খননযন্ত্র) দিয়ে বালু তুলেছি। তবে এখন বালু তুলছি না।’
এদিকে গত তিন দিনে স্থানীয় চর মুকুন্দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোতলা ভবনের এক-তৃতীয়াংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয় ভবনটি ৫০ হাজার ৫০০ টাকায় উন্মুক্ত নিলাম দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবদুল আওয়াল বলেন, ২০০৬ সালে চুর মুকুন্দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোতলা ভবনের এক-তৃতীয়াংশ নদীতে ধসে গেছে। বিদ্যালয়টিতে ২০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। বিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাশের ধুলশুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওই শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নদীভাঙন এবং ভাঙন রোধে জিওব্যাগ ফেলার কার্যক্রম পরিদর্শন করতে গতকাল ঘটনাস্থলে আসেন পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী (কেন্দ্রীয় অঞ্চল) মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন রোধে বালুভর্তি জিওব্যাগের পাশাপাশি জিওটিউব ও ডাম্পিংয়ের কাজ চলছে। ভাঙনপ্রবণ এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে উদ্যোগ নেওয়া হবে।