কুষ্টিয়া পৌর গোরস্তান ‘উন্নয়নে’ কাটা পড়বে ৪৬৫টি গাছ

গাছগুলো ৩০ থেকে ৩৫ বছরের পুরোনো। আবার কোনোটা ১০ বছরের।

কুষ্টিয়া জেলার মানচিত্র

গাছগুলো ৩০ থেকে ৩৫ বছরের পুরোনো। আবার কোনোটা ১০ বছরের। কোনোটার অবস্থান কুষ্টিয়া কেন্দ্রীয় পৌর গোরস্তানের পাশে, আবার কোনোটা সামনে। কোনো কোনো গাছ রয়েছে কবরের মাঝখানেও।

শহরের মধ্যে অবস্থিত প্রায় সাড়ে তিন একর জায়গাজুড়ে এই গোরস্তান উন্নয়ন ও সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। এর অংশ হিসাবে গোরস্তানে বিভিন্ন প্রজাতির ৪৬৫টি গাছ কাটার আয়োজন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে গাছগুলোর দর নির্ধারণসহ কাটার জন্য বিধিগত প্রত্যয়ন চেয়ে চিঠি দিয়েছে তারা। ইতিমধ্যে গাছের বাকল তুলে লাল রং দিয়ে গাছে নম্বর দেওয়া হয়েছে।

নিচু জায়গা মাটি দিয়ে ভরাট করে ২ থেকে ৩ ফুট উঁচু করা হবে। এ জন্য কিছু গাছ কাটা লাগছে। সব গাছ চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। চিহ্নিত সব গাছ কাটা হবে না। যেগুলো প্রয়োজন, সেগুলো কাটা হবে।
শাহিন উদ্দীন, প্যানেল মেয়র, কুষ্টিয়া পৌরসভা

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুষ্টিয়ার কর্মী মো. জাহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গোরস্তানের গাছগুলো শহরের অক্সিজেনের ভান্ডার। উন্নয়নের দোহায় দিয়ে গাছগুলো কেটা ফেলা কাম্য নয়। প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। আরও তীব্র আন্দোলন করা হবে। একটি গাছও কাটতে দেওয়া হবে না।’

গত ২৪ জানুয়ারি পৌরসভার মেয়র আনোয়ারুল আলী স্বাক্ষরিত এক চিঠি সামাজিক বন বিভাগ কুষ্টিয়া বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, কুষ্টিয়া পৌর ১ নম্বর গোরস্তানে বিভিন্ন প্রজাতির ৪৬৫টি গাছের দর নির্ধারণ ও কাটার বিধিগত প্রত্যয়ন প্রদান করা হোক।

লোকাল গভর্নমেন্ট কোভিড-১৯ রেসপন্স অ্যান্ড রিকভারি প্রকল্পের আওতায় গোরস্তানের সার্বিক উন্নয়ন করা হবে জানিয়ে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে এ ব্যাপারে বন বিভাগের প্রত্যায়ন প্রয়োজন। গণনা করা গাছের তালিকাও পাঠানো হয়।

তালিকাতে মেহগনি ১৩৪টি, আম ৫৭, বকুল ১১৮, জাম ২৩, নিম ১৯, শিউলি ১৯, অর্জুন ১০, কাঁঠাল ৪, পেয়ারা ১৪, কৃষ্ণচূড়া ৭, কাঠবাদাম ৩টিসহ দেবদারু, শিমুল, পলাশ, পাম, শিশু, কদম, চালতা, জামরুল, কামরাঙা মিলিয়ে ৪৬৫টি শনাক্ত করা হয়েছে।

শহরের প্রায় মাঝখানে সাড়ে তিন একর জায়গাজুড়ে পৌর গোরস্তান। সেখানে মসজিদ রয়েছে। এক পাশে টালিপাড়া, কালিশংকরপুর ও পেয়ারাতলা এলাকা। গোরস্তানের সামনে সড়কের পাশে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল। শহরের সাড়ে তিন একর জায়গাজুড়ে এত বড় গাছের সমাহার আর কোথাও নেই। আশপাশের ভবনের বাসিন্দাদের এটা সবচেয়ে বড় অক্সিজেন প্রাপ্তির জায়গা।

এ ছাড়া গোরস্তানের ভেতর এত পরিমাণ গাছ যে সেখানে সব সময় ছায়া থাকে। যে কারণে প্রায় সময় মানুষ তাঁর স্বজনদের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বা বসে দোয়া দরুদ পড়তে পারেন। শীতল পরিবেশ থাকে।

গাছ কাটার আয়োজনের প্রতিবাদ করেছেন পৌরসভার বাসিন্দা ও মুসল্লিরা। গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর কুষ্টিয়ার একাধিক সামাজিক, পরিবেশবাদী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গোরস্তানের সামনে প্রতিবাদ–মানববন্ধন করে। তাদের সঙ্গে মুসল্লিরাও যোগ দেন।

মানববন্ধনে নানা ধরনের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘আমি বৃক্ষ, আমাকে বাঁচান—আপনারা বাঁচুন’, ‘কবরস্থানে নাগরিকের কথা শুনুন—গাছ কাটা বন্ধ করুন’, ‘গোরস্তানে গাছ হত্যা বন্ধ কর।’

বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল কুষ্টিয়া জেলা শাখার সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, এটা স্পর্শকাতর জায়গা। এ গাছগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ লাগিয়েছেন। সেখানে আবেগ জড়িত রয়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষ পৌরবাসীকে নিয়ে একটা সংলাপ করতে পারত। উন্নয়ন হবে, তাই বলে গাছ কেটে উন্নয়ন হতে পারে না। অনেক বছরের পুরোনো গাছ কেটে ফেলা ঠিক হবে না।

বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশনের (বিবিসিএফ) সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া বার্ডক্লাবের সভাপতি এস আই সোহেল

প্রথম আলোকে বলেন, গোরস্তানে বিভিন্ন প্রজাতির যে পরিমাণ গাছ রয়েছে, তা শহরের আর কোথাও নেই। এখানে প্রচুর পাখির আবাসস্থল। গাছ কাটা হলে পাখিগুলো কোথায় যাবে। প্রকৃতি ও পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখতে গাছ না কেটে উন্নয়ন করতে হবে। পরিবেশ ধ্বংসের নীতি থেকে সরে এসে শহরজুড়ে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ত্বরান্বিত করতে হবে।

মানুষ মানুষের জন্য সংগঠনের সভাপতি শাহাবউদ্দিন মিলন বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময় বাংলাদেশের তাপমাত্রার রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়েছে, এমতাবস্থায় অক্সিজেনের অকৃত্রিম উৎস গাছ কাটার সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। উষ্ণায়নের মধ্যে এমন প্রকৃতি বিধ্বংসী নীতি জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।’

কুষ্টিয়া পৌরসভার প্যানেল মেয়র শাহিন উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গোরস্তান সংস্করণে পায়ে হাঁটা সড়ক, নালা নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া নিচু জায়গা মাটি দিয়ে ভরাট করে ২ থেকে ৩ ফুট উঁচু করা হবে। এ জন্য কিছু গাছ কাটা লাগছে। সব গাছ চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। তবে চিহ্নিত সব গাছ কাটা হবে না। যেগুলো প্রয়োজন, সেগুলো কাটা হবে।