উপকূলে ঘরবাড়ি হারিয়ে শহরের বস্তিতে মোবারক, দুর্ভোগের শেষ নেই

ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভিটেমাটি হারিয়ে নদীর বাঁধের বাইরে আশ্রয় নিয়েছে অনেক পরিবার। সম্প্রতি খুলনার কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন শাকবাড়িয়া নদীর তীর থেকে তোলাছবি : ইমতিয়াজ উদ্দীন

সামাদ সানা ছিলেন সচ্ছল। বসতবাড়ি খুলনার কয়রার চরামুখা গ্রামে। নদীভাঙন আর ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কায় সব হারিয়ে এখন নদীর চরে অস্থায়ী ঘরে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। তাঁর স্ত্রী আনজুয়ারা বেগম বলেন, ‘চার বিঘা জমি ছিল, এখন কিচ্ছু নেই। নদীর নোনাপানিতেই গোসল, রান্না—সব করতি হয়। খাবার পানি আনতি হয় দূর থেইকে। নদীর সঙ্গে যুদ্ধ কইরেই বাঁইচে আছি আমরা।’

এমন গল্প উপকূলের প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই। শাকবাড়িয়া নদী–তীরের মোবারক হোসেন ২২ বিঘা চিংড়িঘের ও পাকা ঘর হারিয়ে শহরের বস্তিতে ঠাঁই নিয়েছেন। কয়রার বামিয়া গ্রামের কামরুল সরদার ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর সব হারিয়ে খুলনা শহরে দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন। কেউ রিকশা চালাচ্ছেন, কেউ ঠেলাগাড়ি, কেউবা ভ্যান—সবাই জীবিকার সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী।

খুলনা জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ বছরে উপকূলে আঘাত হেনেছে ১৩টি ঘূর্ণিঝড়। সিডর, আইলা, ফণী, বুলবুল, আম্পান, ইয়াস—সবই রেখেছে গভীর ক্ষত। তবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সঠিক সংখ্যা নেই সরকারের কাছে। নরওয়েভিত্তিক আইডিএমসির হিসাবে, শুধু ২০২৪ সালেই বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ২৪ লাখের বেশি।

এমন বাস্তবতায় আজ সোমবার থেকে ব্রাজিলের বেলেম শহরে শুরু হচ্ছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-৩০। ১১ দিনব্যাপী এই সম্মেলনে বাংলাদেশ জোরালোভাবে দাবিগুলো তুলে ধরার প্রস্তুতি নিয়েছে।

দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ প্রতিনিয়ত জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার সঙ্গে যুদ্ধ করছে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের বিস্তীর্ণ উপকূল এখন ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং নদীভাঙনের চক্রে বিপর্যয়ের কেন্দ্রবিন্দু। স্থানীয় লোকজন জানাচ্ছেন, প্রতিবছর ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙনের কারণে উপকূলীয় মানুষের জীবনযাত্রা, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন, অনেকেই পুষ্টিকর খাদ্য থেকে বঞ্চিত। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের অভাবে নারী ও মেয়েদের মধ্যে জরায়ু ও প্রজননজনিত রোগ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘উপকূলে লবণাক্ততা ও কর্মসংস্থানের অভাবে মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু সেখানেও দারিদ্র্য, জলাবদ্ধতা ও নোংরা পরিবেশে তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই।

উপকূলীয় কয়রা উপজেলার ঘোড়িলাল গ্রামের অহিদুল ইসলাম বলেন, ‘একসময় ধানভরা মাঠ ছিল, এখন সব ঘেরের নিচে। লবণাক্ততার কারণে জমি মরে গেছে। এখন আমরাই অন্য জেলায় ধান কাটতে যাই।’

হড্ডা গ্রামের আমেনা বেগমের কথায় উঠে আসে লবণাক্ততার নির্মমতা। তিনি বলেন, ঘেরের নোনাপানিতে গাছপালা মরে যাচ্ছে, মানুষ পেটের সমস্যা আর চর্মরোগে ভুগছেন। যদি এমনই চলে, এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে।

১৯৭৩ সালে দেশে ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর লবণাক্ত জমি থাকলেও ২০২২ সালের জরিপে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখ হেক্টরে। গত ৫০ বছরে লবণাক্ত জমি বেড়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, খুলনার মাটির লবণাক্ততা ৫ দশমিক ৯৭ থেকে ১২ দশমিক ০২ ডিএস/মিটার পর্যন্ত পৌঁছেছে। ১৯৭৩ সালে দেশে ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর লবণাক্ত জমি থাকলেও ২০২২ সালের জরিপে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখ হেক্টরে। গত ৫০ বছরে লবণাক্ত জমি বেড়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ।

সাতক্ষীরার সোনাখালীর কবির গাজী বলেন, ‘চার বছর ধরে বাড়ির উঠানে একটা আমগাছ লাগানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু প্রতিবছরই শুকিয়ে মরে যায়। চিনি মিশিয়ে মাটিকে মিষ্টি করার চেষ্টা করছিলাম, তাতেও লাভ হলো না।’

কয়রার মহেশ্বরীপুর, মঠবাড়ি ও সোনাপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নারীরা নদীর নোনাপানিতে গোসল ও গৃহস্থালির কাজ করছেন। মহেশ্বরীপুর গ্রামের আম্বিয়া বেগম বলেন, ‘নোনাপানির কারণে মেয়েদের ছোট বয়সেই বিয়ে দিতে হয়, না হলে চেহারা কালো হয়ে যায়। দূরের আত্মীয়স্বজন আসতেও চান না।’

কয়রার মহেশ্বরীপুরের কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী সুলতা মণ্ডল বলেন, লবণাক্ততার কারণে এখানে চর্মরোগ, পেটের পীড়া ও উচ্চ রক্তচাপ সাধারণ সমস্যা। সবচেয়ে বেশি ভোগেন গর্ভবতী মায়েরা—অপরিণত সন্তানপ্রসব ও ভ্রূণ নষ্ট হওয়ার ঘটনা বেড়েছে।

বাঁধের বাইরে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের আবাসস্থল পানিতে ডুবে গেছে। সম্প্রতি খুলনার কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন শাকবাড়িয়া নদীর তীর থেকে
ছবি : ইমতিয়াজ উদ্দীন

সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রার পাথরখালী, হারেজখালী ও পাবনা এলাকায় ঘূর্ণিঝড় আইলা ও আম্পানের ক্ষত এখনো স্পষ্ট। জলোচ্ছ্বাসে তৈরি খালে এখনো নোনাপানি জমে আছে। বেড়িবাঁধের পাশে শত শত পরিবার এখনো বসবাস করছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক নাজমুস সাদাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও উপকূলের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে গবেষণার ঘাটতি রয়েছে। সুন্দরবনের ক্ষতি নিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত নেই। গবেষণা বাড়াতে হবে আর আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও শক্ত অবস্থান নিতে হবে।

গত বছর কপ-২৯ সম্মেলনে অংশ নেওয়া গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এস এম শাহিন আলম বলেন, ‘আমাদের তরুণ প্রতিনিধিরা প্রস্তুত। বড় চ্যালেঞ্জ তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন ও লবিং। এখন পর্যন্ত যে ক্ষতিপূরণ পাই, তা খুবই সামান্য ও ঋণ হিসেবে। অথচ এটা গ্র্যান্ট (অনুদান) হওয়া উচিত। এবারে আমরা সেটাই জোরালোভাবে দাবি করব।’

উপকূলীয় মানুষের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের দাবিগুলো স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেওয়াই মূল লক্ষ্য। সে অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি।
ফারুক ই আজম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা

আসন্ন সম্মেলনে উপকূলীয় ক্ষতি, বাস্তুচ্যুতি ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে চায় বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং দাবিনামা চূড়ান্ত করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় অঞ্চলের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে রাখা হয়েছে বিশেষ উপস্থাপনাও।

এ বিষয়ে গত শনিবার মুঠোফোনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, ‘উপকূলীয় মানুষের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের দাবিগুলো স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেওয়াই মূল লক্ষ্য। সে অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি।’

উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব সাইফুল ইসলাম বলেন, আজ থেকে ব্রাজিলের বেলেম শহরে বিশ্বের ১৯৮টি দেশের প্রতিনিধিরা জলবায়ু অর্থায়ন, কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষতিপূরণ কাঠামো নিয়ে আলোচনা করবেন। বাংলাদেশের মানুষের আশা—এবার হয়তো ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি কেবল কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবেও রূপ পাবে।