‘বাবা-মা ও ভাইকে হারিয়ে ওর জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল’
বাবা-মা ও একমাত্র ভাইকে হারিয়ে শিশু ফাহিম সিদ্দিকী (৯) নির্বাক। গত বৃহস্পতিবার রাতেই বাবা-মা ও ভাইকে সবাই মিলে কবর দিয়েছে। প্রতিবেশী ও স্বজনেরা আসছেন তাদের বাড়িতে। তাকে ধরে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন কেউ কেউ। কিন্তু ফাহিমের মুখে কোনো কথা নেই। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছে।
আজ শুক্রবার দুপুরে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের ভবনদত্ত গ্রামে ফাহিমদের বাড়িতে গিয়ে এ চিত্র দেখা যায়।
ফাহিমের বাবা ফারুক হোসেন সিদ্দিকী (৫০) ভবনদত্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ফাহিমের অসুস্থ ভাই ফুয়াদ সিদ্দিকীকে (১৪) নিয়ে গত বুধবার রাত ১১টার দিকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন পরিবারের সদস্যরা। বুধবার দিবাগত রাত ২টার দিকে তাঁদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স ঢাকার সাভারে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
অ্যাম্বুলেন্সটিতে আগুন ধরে যায়। এতে ফাহিমের বাবা ফারুক, ভাই ফুয়াদ, মা মহসিনা সিদ্দিকী (৩৮) ও তাঁর খালা সীমা আক্তার (৪০) নিহত হন।
ফাহিমদের স্বজন রফিকুল ইসলাম বলেন, এইটুকু ছেলে, এত বড় শোক সইবে কীভাবে। বাবা-মা ও ভাইকে হারিয়ে ওর জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল। রফিকুল যখন এ কথা বলে কান্না করছিলেন, তখন নির্বাক ফাহিম ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, তাঁদের মৃত্যুর খবর গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে বাড়িতে পৌঁছে। তখনই স্বজনদের কান্নার রোল শুরু হয়। কান্না শুনে প্রতিবেশীরা এগিয়ে এসে জানতে পারেন এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর। ফাহিম পাশের গোপালপুর উপজেলায় একটি মাদ্রাসায় হোস্টেলে থেকে নুরানি বিভাগে পড়ত। গতকাল স্বজনেরা তাকে গোপালপুর থেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। চাচা মামুন সিদ্দিকীসহ স্বজনেরা তাকে ধরে কান্নাকাটি শুরু করেন। কিন্তু ফাহিম ছিল নির্বাক। গতকাল রাতে বাবা, মা, ভাই, খালার লাশ তাঁদের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। এ সময় ফাহিমের খালা সীমা আক্তারের ছেলে মোরসালিন (১৫) কান্নায় ভেঙে পড়ে। মোরসালিনকে ফাহিম সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘তোমার তো বাবা বাঁইচা আছে, আমার তো কেউ নাই।’
ফাহিমের চাচা মামুন সিদ্দিকী জানান, ফাহিম তাঁদের সঙ্গে রয়েছে। বাবা, মা ও ভাইকে কবর দিয়ে আসার পরও ছিল চুপচাপ। আজ সকালে উঠে শুধু বলেছে, ‘বাবা নাই, মা নাই, কে আমারে মাদ্রাসায় নিয়া যাবে।’
মামুন সিদ্দিকী জানান, ফুয়াদ সিদ্দিকী ভবনদত্ত উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল। ফুয়াদ রক্তরোগে আক্রান্ত। এর আগে ঢাকায় চিকিৎসা নিয়েছে। ফুয়াদ তার মায়ের সঙ্গে বুধবার নানার বাড়ি গোপালপুরের মাকুল্যা গ্রামে অবস্থান করছিল। রাতে ফুয়াদের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। চিকিৎসক ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেন। গোপালপুর থেকে মহসিনা ও সীমা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। ঘাটাইলের হামিদপুর বাস্টস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ফারুক হোসেন রাত ১১টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠেন।
স্থানীয় দেওপাড়ার ইউপি চেয়ারম্যান রুহুল আমিন ওরফে হেপলু জানান, বুধবার রাত ১১টার দিকে ফারুক সিদ্দিকীর সঙ্গে তিনি একসঙ্গে চা পান করেন। পরে অ্যাম্বুলেন্স এলে তাঁকে উঠিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে যান। সকালে উঠেই তাঁদের মৃত্যুর সংবাদ পান।
ভবনদত্ত গ্রামের বাসিন্দা সোমা সিদ্দিকী বলেন, সবার চিন্তা এখন ফাহিমকে নিয়ে। এতটুকু ছেলে। ওর কেউ রইল না।
ফাহিমের চাচাতো চাচা জাকির হোসেন সিদ্দিকী বলেন, এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। বাবা–মা, ভাইকে হারিয়ে ফাহিম কীভাবে বাঁচবে।