দল ছেড়ে ভোটের মাঠে ‘ধরা খেলেন’ শাহীনূর

সুনামগঞ্জ-৩ আসনে (জগন্নাথপুর ও শান্তিগঞ্জ) ২০০১ সাল থেকে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি নেতা শাহীনূর পাশা চৌধুরী। এর মধ্যে একবার তিনি সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন। তবে এবার এত কম ভোট পেয়েছেন যে জামানত হারাতে হয়েছে তাঁকে।

স্থানীয় লোকজন বলেন, এবার ‘ভোটে পাসের আশায়’ নির্বাচনের আগে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থাকা শাহীনূর পাশা নিজের দল ছেড়ে যোগ দেন তৃণমূল বিএনপিতে। সেটাতে ফল হয়েছে উল্টো। দল পরিবর্তন করায় জমিয়তে উলামায়ের সমর্থকদেরও ভোট পাননি। এখন ভোটের মাঠে আলোচনা, নিজের দলে থাকলে এমন করুণ দশা হতো না তাঁর।

এবার এ আসনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি পেয়েছেন ১ লাখ ২৬ হাজার ৯৯৫ ভোট। আর শাহীনূর পাশা পেয়েছেন ৪ হাজার ৯৫ ভোট। আগের কোনো নির্বাচনে তিনি এত কম ভোট পাননি।

সুনামগঞ্জ-৩ আসনের গত পাঁচটি নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শাহীনূর পাশা চৌধুরী এ আসনে ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তখন পরাজিত হলেও ভোট পেয়েছিলেন ৬৩ হাজার ৪৭৫টি। আর জয়ী আবদুস সামাদ আজাদ পেয়েছিলেন ৬৯ হাজার ৪২১টি।

২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে আবদুস সামাদ মারা যান। তখন উপনির্বাচনে শাহীনূর পাশা আবার জোটের প্রার্থী হন। তখন আওয়ামী লীগ ভোটে অংশ নেয়নি। এই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তখন এম এ মান্নান পান ৩৯ হাজার ভোট, আর শাহীনূর পান ৪৪ হাজার ভোট। এই নির্বাচনে জয়ী হন পাশা।

এরপর এম এ মান্নান যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় দুজনের। এই নির্বাচনে এম এ মান্নান পান ১ লাখ ৩৪ হাজার ৫৫ ভোট পান। শাহীনূর পাশা পান ৫৬ হাজার ৭৬৫ ভোট। ২০১৪ সালের নির্বাচনে শাহীনূর পাশা অংশ নেননি। ২০১৮ সালে এম এ মান্নান পান ১ লাখ ৬৩ হাজার ১৪৯ ভোট। শাহীনূর পাশা পান ৫২ হাজার ৯২ ভোট।

স্থানীয় লোকজন বলেন, এবার ভোটের তোড়জোড় শুরু হলে গত ২৩ নভেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন শাহীনুর পাশা চৌধুরী। সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের আরও কয়েকজন নেতা ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পরদিন দলীয় পদ স্থগিত করার কথা জানিয়ে জমিয়তের কেন্দ্রীয় মহাসচিব চিঠি পাঠান শাহীনুর পাশাকে। এরপর ওই দিন সন্ধ্যায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম থেকে পদত্যাগ করে তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেন তিনি। শাহীনুর পাশা তখন বলেছিলে, ‘জমিয়তের জন্য জীবন-যৌবন শেষ করেছেন। এখন দলের একটি অংশ তাঁকে বাধ্য করছে দল ছাড়তে।’

এরপর ৩১ নভেম্বর জগন্নাথপুরে নির্বাচনী সভায় তিনি বলেন, ‘শতভাগ আসন নিশ্চিত করে আমি আমার দীর্ঘদিনের প্রাণের সংগঠন উলামায়ে কেরামের দল জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম ছেড়ে প্রার্থী হয়েছি।’ তাঁর এ বক্তব্যে এলাকায় নানা আলোচনা শুরু হয়। কারণ, এ আসনটি আওয়ামী লীগের ‘হেভিওয়েট প্রার্থী’ এম এ মান্নানের।

এলাকার লোকজন বলেন, সুনামগঞ্জ-৩ আসনের শান্তিগঞ্জ উপজেলায় জমিয়তের মোটামুটি অবস্থান আছে। কিন্তু এবার দল ছাড়ায় নির্বাচনী মাঠে শাহীনূর পাশার পাশে দলের তেমন কেউ ছিলেন না। পাশা অনেকটা একা একাই ঘুরেছেন। বিভিন্ন স্থানে গরম বক্তব্য দিলেও মাঠে তাঁর অবস্থা ছিল একবারে নড়বড়ে।

জমিয়ত উলামায়ে ইসলামের জগন্নাথপুর উপজেলা শাখার সভাপতি সৈয়দ মছরুর আহমদ কাশেমী বলেন, জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম এবার নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তাই দলের নেতা-কর্মীরা ভোট দিতে যাননি। শাহীনূর পাশা দল বদল করে প্রার্থী হয়ে জামানত হারিয়ে মানসম্মান হানি করলেন।

উপজেলা বিএনপি সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মোসাব্বির বলেন, বিএনপি এ আসনে শক্ত অবস্থানে থাকার পরও এর আগে শরিক দল হিসেবে এ আসন জমিয়তকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ধানের শীষ প্রতীকে শাহীনূর পাশা সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন। সবার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তিনি সব হারালেন।

শাহীনূর পাশা চৌধুরী মঙ্গলবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, দল ছাড়লেও ৯০ শতাংশ নেতা-কর্মী তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাহলে এবার ভোট এত কম কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভোট তো অনেক পাইছি। কিন্তু হিসাবে আসেনি। খয়রাতি হিসেবে তারা যা দিচ্ছে, সেগুলোই হিসাবে দেখানো হয়েছে।’ তারা কারা—এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এসব তো সবাই জানে। আমি আর বলে লাভ নাই।’