নোয়াখালী-২
নির্বাচন ঘিরে বিএনপির বিরোধ প্রকাশ্যে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা এক নেতার
বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে এক জোট হয়েছেন দলের মনোনয়নবঞ্চিত দুই নেতা ও তাঁদের অনুসারীরা। দুই নেতার একজন দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচনে লড়ার ঘোষণাও দিয়েছেন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নোয়াখালী-২ (সেনবাগ ও সোনাইমুড়ী আংশিক) আসনে বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিরোধ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। এ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে এক জোট হয়েছেন দলের মনোনয়নবঞ্চিত দুই নেতা ও তাঁদের অনুসারীরা। দুই নেতার একজন দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচনে লড়ার ঘোষণাও দিয়েছেন।
আসনটিতে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক। তাঁর বিপক্ষে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মফিজুর রহমান। তাঁর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে দলের আরেকটি পক্ষ। ওই পক্ষটি সৌদি আরব পূর্বাঞ্চল বিএনপির সহসভাপতি আবদুল মান্নানের অনুসারী।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জয়নুল আবদিন ফারুকের রাজনীতির পাশাপাশি তৈরি পোশাক খাতে ব্যবসা রয়েছে। তিনি নোয়াখালী-২ আসনে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৯১ সালে। সেই থেকে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত পাঁচটি নির্বাচনেই (৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনসহ) তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এবার মনোনয়ন চাইলাম, এবারও দেওয়া হয়নি। তাই আমি দলের নেতা-কর্মী ও ভোটারদের চাপে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছি।
কাজী মফিজুর রহমান ১৯৯৭ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। কাজী মফিজুর পেশায় একজন ব্যবসায়ী। এ ছাড়া একটি বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকও তিনি। কাজী মফিজুর রহমান ২০০১ সাল থেকে প্রায় প্রতিটি সংসদ নির্বাচনেই দলের কাছে মনোনয়ন চেয়েছেন। এর মধ্যে ২০০৮ সালে তাঁকে দলের মনোনয়নও দেওয়া হয়। তবে ঋণ খেলাপির অভিযোগ ওঠায় পরে জয়নুল আবদিন ফারুককে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল।
সেনবাগে বিএনপির রাজনীতিতে কাজী মফিজুর রহমান ও জয়নুল আবদিন ফারুকের দ্বন্দ্ব দুই দশকের বেশি সময়ের। অতীতে দুজনের অনুসারীদের মধ্যে অনেকবার সংঘাতও হয়েছে। টানা ২৬ বছর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন ফারুক। এরপর ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর তাঁর বড় মেয়ে তামান্না ফারুক ওই পদে আসেন। তাঁর মেয়ে দলের একই পদে আসায় স্থানীয় নেতা-কর্মীদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ ছিলেন। এই ক্ষোভ থেকে অনেকেই ফারুকের পক্ষ ছেড়ে মফিজুরের পক্ষে চলে যান।
আজ শনিবার সকালে সেনবাগ উপজেলা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের পাঁচজন জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা জানান, আগে সেনবাগ বিএনপি ফারুক ও মফিজুর—এই দুই বলয়ে বিভক্ত ছিলেন। এখন এর সঙ্গে সৌদি আরব পূর্বাঞ্চল বিএনপির সহসভাপতি আবদুল মান্নানের অনুসারী হিসেবে স্থানীয় রাজনীতিতে একটি অংশ সক্রিয়। মান্নানের গ্রামের বাড়ি সোনাইমুড়ী উপজেলার অম্বনগর। তিনিও দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন।
জয়নুল আবদিন ফারুককে এবারও দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় মফিজুর ও মান্নানের অনুসারী ক্ষুব্ধ। প্রার্থী ঘোষণার পর তাঁরা মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ, সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করেন। তাতেও কাজ না হওয়ায় গত ২৫ নভেম্বর দুই নেতা ও তাঁদের অনুসারীরা এক সমঝোতা বৈঠকে বসেন। আবদুল মান্নানের বাড়িতে আয়োজিত ওই বৈঠকে দুটি পক্ষ যৌথভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
বিএনপির নেতারা বলেন, জয়নুল আবদিন ফারুককে এবারও দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় মফিজুর ও মান্নানের অনুসারী ক্ষুব্ধ। প্রার্থী ঘোষণার পর তাঁরা মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ, সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করেন। তাতেও কাজ না হওয়ায় গত ২৫ নভেম্বর দুই নেতা ও তাঁদের অনুসারীরা এক সমঝোতা বৈঠকে বসেন। আবদুল মান্নানের বাড়িতে আয়োজিত ওই বৈঠকে দুটি পক্ষ যৌথভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
জানতে চাইলে বিএনপি নেতা আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনগণ যেদিকে, আমরা সেদিকে। সেনবাগ-সোনাইমুড়ীর মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে। আমরাও তাঁদের পক্ষে রয়েছি। যাঁরা বিগত ৩০ বছরে কিছু করতে পারেননি, তাঁরা এখন আর কিছু করতে পারবেন না।’
আবদুল মান্নানের অনুসারী পরিচিত সেনবাগ পৌরসভা বিএনপির আহ্বায়ক মফিজুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কাজী মফিজুর রহমান প্রার্থী হওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে তাঁরাও একমত। মফিজুর রহমান নির্বাচন করার বিষয়ে দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মী এবং সাধারণ ভোটারদের চাপ রয়েছে।
দলের নেতা-কর্মীদের কোন্দল প্রকাশ্যে আসার মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার কাজী মফিজুর রহমানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জয়নুল আবদিন ফারুক। তবে মফিজুর নিজেও নির্বাচন করবেন বলে সাক্ষাতে ফারুককে জানান। রাতে নিজের অনুসারীদের কাছে অডিও বার্তা পাঠিয়েও বিষয়টি জানান মফিজুর।
৩০ বছর ধরে দলের কাছে মনোনয়ন চেয়ে আসছেন জানিয়ে কাজী মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০৮ সালের নির্বাচনে দল আমাকে মনোনয়ন দিলেও মিথ্যা অভিযোগে আমার মনোনয়ন ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এবার মনোনয়ন চাইলাম, এবারও দেওয়া হয়নি। তাই আমি দলের নেতা-কর্মী ও ভোটারদের চাপে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছি।’
ফারুকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মুক্তার হোসেন পাটোয়ারী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাজী মফিজুর রহমানের স্বতন্ত্র নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত তাঁর ব্যক্তিগত। আমরা দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে দলের প্রার্থীর পক্ষে আছি। দলের প্রার্থীর বিপক্ষে গিয়ে কেউ ভোট করলে সে বিষয়ে দল সিদ্ধান্ত নেবে।’
জানতে চাইলে জয়নুল আবদিন ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, দলের কয়েকজন নেতা তাঁকে মফিজুর রহমানের কার্যালয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে মফিজুর নির্বাচন করবেন বলে তাঁকে জানান। এ বিষয়ে তাঁর কিছু বলার নেই।
সেনবাগ বিএনপির একজন প্রবীণ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্বাচন নিয়ে জেলার তিনটি আসনে অসন্তোষ রয়েছে, এর মধ্যে নোয়াখালী-২ আসন অন্যতম। দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া অংশটি তাঁদের অবস্থানে অনড়। বিষয়টির সমাধান করতে না পারলে তা দলের জন্য ক্ষতিকর হবে।
জেলা বিএনপির সদস্যসচিব হারুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল, এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা আছে থাকবে। জেলা কমিটি বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত দলের সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন বলে আশা তাঁর।