একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি কারাগারে, সংসারে অচলাবস্থা

সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে কারাগারে আছেন ভ্যানচালক সিরাজুল ইসলাম। দেড় বছর বয়সী মেয়েকে কোলে নিয়ে জীর্ণশীর্ণ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সিরাজুলের স্ত্রী ফরিদা বেগম। শুক্রবার কয়রা উপজেলা সদরের দেউলিয়া বাজারসংলগ্ন এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে গত ২৯ অক্টোবর রাতে শাহানুরকে ডেকে নিয়ে যায় পুলিশ। সে সময় তাঁর পরিবারকে জানানো হয়, জিজ্ঞাসাবাদের পর সকালে ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে এক মাসের বেশি সময় পার হলেও ছাড়া পাননি শাহানুর। বিশেষ ক্ষমতা আইনের একটি মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।

সেলুনে কাজ করে শাহানুরের একার আয়ে চলত পাঁচ সদস্যের সংসার। একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি এক মাস ধরে কারাগারে বন্দী থাকায় এখন অভাব-অনটনে দিন কাটছে পরিবারটির। বর্তমানে তাঁর বৃদ্ধ বাবা শামছুর সরদার দিনমজুরি করে সংসার চালানোর চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে স্বামীকে ছাড়াতে আদালতে ছুটতে হচ্ছে স্ত্রী শারমিন বেগমকে।

কয়রা উপজেলা সদরের পাশের দেউলিয়া বাজারসংলগ্ন নিজ বাড়ি থেকে গত ১ নভেম্বর ভ্যানচালক সিরাজুলকেও ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। একই মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে তিনিও কারাগারে রয়েছেন এক মাসের বেশি সময় ধরে। এখন আদালতের খরচ ও সংসারের খরচ জোগাতে বাধ্য হয়ে তাঁর শিশুপুত্রকে বাবার ভ্যান নিয়ে পথে নামতে হয়েছে।

সিরাজুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর দেড় বছর বয়সী মেয়েকে কোলে নিয়ে জীর্ণ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন স্ত্রী ফরিদা বেগম। তিনি জানালেন, তাঁর স্বামী সকালে ভ্যান নিয়ে বেরিয়েছিলেন। ওই দিন দুপুরে বাড়ি ফেরেননি। সারা দিন পর সন্ধ্যায় ফিরে বাড়ির সামনের রাস্তায় ভ্যান রেখে ভাত নিয়ে বসেছিলেন। তখন পুলিশ এসে সিরাজুলকে ধরে নিয়ে যায়।

ফরিদা বেগম বলেন, ‘একদিন ভ্যান না চালালে সংসার চলে না আমাদের। আমার স্বামী কোনো দিন কোনো রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠানেও যায়নি। তাকে গ্রেপ্তারের পরদিন থেকে আমার শিশুছেলে সংসারের হাল ধরতে ভ্যান নিয়ে বের হচ্ছে। ছোট মেয়েটার চিকিৎসা করতে বাড়ির হাঁস-মুরগিগুলোও সব বিক্রি করে দিয়েছি।’

শাহানুর ও সিরাজুল মতো খুলনার কয়রা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে অর্ধশতাধিক শ্রমজীবী মানুষ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আছেন। প্রতিটি পরিবারের গল্প একই রকম। পরিবারগুলোর দাবি, তাঁরা কেউ সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। অথচ রাজনৈতিক মামলায় তাঁদেরই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বেশি।

গত ২৯ অক্টোবর ও ২ নভেম্বর কয়রা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়। মামলায় ৯৯ জনের নাম উল্লেখসহ দুই শতাধিক অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। এ পর্যন্ত মামলায় ৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের বেশির ভাগই শ্রমজীবী মানুষ। তাঁরা সবাই সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে কারাগারে আছেন।

কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন, কাউকে অহেতুক হয়রানি করা হচ্ছে না। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে সরকার পতনের উদ্দেশ্যে নাশকতামূলক কাজ করতে একত্র হয়েছিলেন। এ ঘটনায় জড়িত থাকার বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কয়রার মেঘারাইট গ্রামের জাকিয়া সুলতানা নামের এক নারী বলেন, তাঁর স্বামী আবু সালেক ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করেন। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁর একার আয়েই চার সদস্যের সংসার চলত। এর মধ্যে দুই ছেলে খুলনা শহরের বিএল কলেজে পড়াশোনা করছে। গত ২৯ অক্টোবর গভীর রাতে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আবু সালেককে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এখন বাবাকে ছাড়াতে কলেজপড়ুয়া দুই ছেলের দিন কাটছে আদালতের বারান্দায়।

বাবাকে ছাড়াতে এক মাস ধরে এক আদালত থেকে আরেক আদালতে ঘুরছেন রেশমা খাতুন। কয়রা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন না হওয়ায় কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছিলেন খুলনা জেলা জজ আদালতে। কিন্তু সেখানেও হয়নি। আইনজীবীরা বলছেন, উচ্চ আদালতে গেলে হতে পারে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার খরচ জোগাড়ের সামর্থ্য তাঁদের নেই। রেশমা খাতুন বলেন, তাঁর বাবা মুনসুর আলী কয়রা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দলিল লেখকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। বাবার আয়েই তাঁদের সংসার চলত। এখন সংসারের অভাবের সঙ্গে তাঁর বাবাকে ছাড়াতে গিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি।

কয়রা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলার ধারাগুলো সাধারণত জামিন অযোগ্য। এ কারণে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে গ্রেপ্তার আসামিদের জামিন পেতে হয়। কে শ্রমজীবী, কে রাজনীতিবিদ—সে বিবেচনার সুযোগ নেই আদালতে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কয়রা উপজেলা শাখার সভাপতি মোস্তফা শফিকুল ইসলাম বলেন, যেসব মামলায় রাজনৈতিক নেতাদের আসামি করা হয়েছে, সেই মামলায় এলাকার শ্রমজীবী কিছু মানুষকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে মুক্ত করতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পরিবারের অন্য সদস্যদের। শ্রমজীবী মানুষগুলোর ব্যাপারে মানবিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়ার দাবি জানান তিনি।