নদীভাঙনে নিঃস্ব তাঁরা

গত এক সপ্তাহে পদ্মায় ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে। ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে পাঁচ শতাধিক পরিবার।

পদ্মার শাখা নদীতে তীব্র স্রোতে আর ঢেউয়ে ভাঙনে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের সর্দারকান্দি গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পদ্মার শাখা নদীতে প্রচণ্ড ঢেউ এবং তীব্র ঘূর্ণিস্রোতে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে নদীতীরের দুটি গ্রামের অর্ধকিলোমিটার এলাকার ফসলি জমি ও ভিটেমাটি। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে প্রায় ১৫০ পরিবার। নদীগর্ভে চলে গেছে প্রাচীন একটি মন্দির। ভাঙন আতঙ্কে দিন পার করছে আরও পাঁচ শতাধিক পরিবার।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,পদ্মার শাখা নদী দিয়ে প্রতিদিন শত শত বাল্কহেড চলাচল করে। এতে সব সময় নদীতে প্রচণ্ড ঢেউ থাকে। নদীতে এখন প্রচণ্ড ঘূর্ণিস্রোত। এসব কারণে ১৫ দিন ধরে একটু একটু করে নদীর তীর ভাঙছিল। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে। এর মধ্যে শম্ভুহালদারকান্দি ও সর্দারকান্দি গ্রামের ৮০ থেকে ৯০টি বসতভিটা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে প্রায় দুই শ বছরের পুরোনো একটি কালীমন্দির নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন থেকে বাঁচতে ৫০ থেকে ৬০টি পরিবার তাঁদের ঘর ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে একটার দিকে সম্ভুহালদারকান্দি এলাকায় প্রবেশ করতেই দেখা যায় পদ্মার আগ্রাসী ভাঙনের চিত্র। ভাঙন আতঙ্কে সরিয়ে নেওয়া ভিটায় হয়েছে বড় বড় ফাটল। এসব ফাটলে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। নদীর ঢেউ আছড়ে পড়ছে নদীর তীরে। এতে তীরের মাটি নদীর তলদেশে সরে গিয়ে একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে বসতভিটা। সুরোবালা হালদার (৮০) নামে এক বৃদ্ধ নদীর তীরে বসে অপলক দৃষ্টিতে ভাঙন দেখছিলেন। তিনি বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তানদের লগে স্বামীর স্মৃতি বসতভিটা নিয়া বাইচ্চা ছিলাম। সেই ভিটায় জীবনের শেষ পর্যন্ত থাকতে চাইছিলাম। পদ্মার সর্বনাশা ভাঙনে সব শেষ হইয়া গেল। দুই দিন আগে ২০০ বছরের পুরোনো কালিমন্দিরটিও নদীর গর্ভের বিলীন হইয়া গেছে।’

সর্দারকান্দি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ভাঙনের আতঙ্কে দোকানপাট অন্যত্রে সরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কেউ কেউ বসতবাড়ির গাছ কেটে নিচ্ছেন। ভিটেমাটিহারা মানুষ অনেকেই নদীর তীরে অসহায় বসে আছেন। ওই এলাকার সৈয়ালবাড়িতে দেখা যায় প্রায় ২০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫০ ফুট প্রস্থের একটি জায়গায় ১৫ থেকে ২০টি ফাটল ধরেছে। আধা ঘণ্টার ব্যবধানে ওই জায়গার ফাটল বড় হয়ে নদীর সঙ্গে মিশে যেতে শুরু করে।

কথা হয় ৭০ বছর বয়সী রহিমা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, ৩০ বছর আগে তাঁর পরিবার পদ্মার ভাঙনের শিকার হয়েছিল। মানুষের বাড়িতে কাজ করে, তাঁর স্বামী অন্যের জমিতে বদলি দিয়ে ও মেয়ে গার্মেন্টে চাকরি করে ১৫ বছর আগে সর্দারকান্দি গ্রামে একটু জায়গা কিনেছিলেন। ঘরটি বাঁচাতে পারলেও গত বুধবার শেষ সম্বল ভিটেমাটি পদ্মায় বিলীন হয়ে যায়। বৃদ্ধ বয়সে ভিটেমাটি হারিয়ে প্রতিবেশীর বাড়ির বারান্দায় ঠাঁই নিয়েছেন রহিমা ও তাঁর স্বামী।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বাংলাবাজার এলাকায় চলমান নদীভাঙনে ১৫০টি পরিবার ১৯৮টি বসতভিটা হারিয়েছে। ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে চাল ও নগদ অর্থ সহযোগিতা করা হচ্ছে জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হোসাইন মো. আল জুনায়েদ বলেন, ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোর জন্য জরুরি সহায়তা চেয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

তবে ত্রাণের পরিবর্তে ভাঙন রোধে নদীর তীরে স্থায়ী বাঁধ চান ভুক্তভোগীরা। ভাঙনের শিকার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন সোহেল বলেন, ‘আমরা চাল-ডাল সহযোগিতা চাই না। ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হোক। আমরা যারা ভিটাহারা হয়েছি, সরকারে পক্ষ থেকে স্থায়ী একটি থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।’

এদিকে ভাঙন আটকাতে জিও ব্যাগ ফেলতে শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বোর্ডের মুন্সিগঞ্জ নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাবাজারের ভাঙনপ্রবণ ৫০০ মিটার জায়গায় আপৎকালীন ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪১ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হবে।

দুই গ্রামের ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা জানান, ভাঙনের শুরুতেই তাঁরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছিল। তখন কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।