অ্যাটেনডেন্ট সাময়িক বরখাস্ত, বিভাগীয় মামলা, তদন্তে কমিটি

লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেন
ফাইল ছবি

লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনে ভুলবশত উঠে পড়া এক কিশোরীকে (১৪) ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত অ্যাটেনডেন্ট আক্কাস গাজীর (৩২) বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। আজ বৃহস্পতিবার সকালে বিভাগীয় এই মামলা করা হয়েছে। এর আগে গতকাল বুধবার আক্কাস গাজীকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পাশাপাশি এ ঘটনায় চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেল বিভাগ। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

একই ঘটনায় গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে লালমনিরহাট জিআরপি থানায় আক্কাস গাজীর বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা করা হয়। জিআরপি থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. রুহুল আমিন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলাটি করেছেন। মামলার পর এদিন বিকেলে আক্কাস গাজীকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে লালমনিরহাটের আদালতে সোপর্দ করা হলে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। আক্কাস গাজীর বাড়ি বরিশাল সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ এলাকায়।

এদিকে আজ দুপুরে ভুক্তভোগী কিশোরী লালমনিরহাট চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। এরপর বিকেলে তাকে আদালতের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

লালমনিরহাট জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফেরদৌস আলী বলেন, আজ সকালে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে মেয়েটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে ও তার ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়েছে। এরপর মেয়েটি আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। বিকেলে তার পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে ময়মনসিংহে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।

আরও পড়ুন

লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলওয়ে কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনের কেবিনে ধর্ষণের অভিযোগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করতে লালমনিরহাট রেল বিভাগীয় ম্যানেজার (ডিআরএম) আবদুছ সালাম নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশনার আলোকে বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুনকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী মো. তাসরুজ্জামান, লালমনিরহাট রেল বিভাগীয় হাসপাতালের চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া এবং লালমনিরহাট রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ড্যান্ট শফিকুর রহমান। তদন্ত কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে লালমনিরহাট রেল বিভাগীয় ম্যানেজারকে লিখিত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির সদস্য মো. তাসরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, যাত্রীরা রেলওয়ের আমানত, তাঁদের কোনো রকম অনিষ্ট করা গুরুতর অপরাধ। এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

জিআরপি থানায় মামলার বাদী এএসআই মো. রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আক্কাস গাজীকে লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনের কেবিনে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদকালে তিনি কিশোরীর অভিযোগ স্বীকার করে নেন এবং উপস্থিত সবার সামনে আমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে থাকেন। যা আমি মামলার এজাহারেও উল্লেখ করেছি।’

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, যে লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনটিতে এই ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেটি ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে গত মঙ্গলবার রাতে লালমনিরহাটের উদ্দেশে ছেড়ে গিয়েছিল। ওই ট্রেনে ভুলবশত উঠে পড়েছিল ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের ওই কিশোরী। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় লালমনিরহাটের তিস্তা রেলস্টেশনে এসে পৌঁছায়। তখন ট্রেনে কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ট্রেনের ‘খ’ বগির ৭ নম্বর কেবিনের ভেতর থেকে একটি মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পান। তখন কেবিনের দরজা বন্ধ ছিল। এ অবস্থায় প্রচুর ধাক্কাধাক্কি ও ডাকাডাকির পর কেবিনের ভেতরে থাকা অভিযুক্ত অ্যাটেনডেন্ট আক্কাস গাজী দরজা খুলে দেন। তখন ওই কিশোরীকে বিবস্ত্র অবস্থায় পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন

এজাহারে আরও বলা হয়, মেয়েটিকে উদ্ধারের পর উপস্থিত লোকজন জিজ্ঞাসা করলে সে পুরো ঘটনা খুলে বলে। মেয়েটি জানায়, তার জয়দেবপুর রেলস্টেশন থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার কথা ছিল। ভুলবশত সে লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠে পড়ে। রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে ট্রেনের অ্যাটেনডেন্ট আক্কাস গাজী তার টিকিট চেক করতে আসেন। তার কাছে টিকিট না থাকায় আক্কাস গাজী তাকে একটি আসনে বসিয়ে দেন। এরপর আনুমানিক সকাল সাড়ে আটটার দিকে অ্যাটেনডেন্ট আসন থেকে তাকে কেবিনে এনে দরজা বন্ধ করে ধর্ষণ করেন।

মেয়েটিকে উদ্ধারের পর লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। আজ সকালে ওই হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসা কর্মকর্তা হাসিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যথাসম্ভব দ্রুত রিপোর্ট দিতে চেষ্টা করব। ভিকটিমের ডিএনএ নেওয়া হয়েছে, ঢাকায় পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে।’ ধর্ষণের আলামত রয়েছে কি না, প্রশ্নে চিকিৎসক হাসিনা বলেন, ‘ভিকটিমের সঙ্গে কথা বলে ও রকমটা মনে হয়েছে। নিশ্চিত হতে চূড়ান্ত রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’

লালমনিরহাটের নারী অধিকার সংগঠক এস তাবাসসুম রায়হান মুসতাযীর বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা নারীদের ট্রেনযাত্রায় নিরুৎসাহিত করতে পারে। এমন জঘন্য অপকর্মে জড়িত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হলে যাত্রীসাধারণ, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের আস্থা ফিরে আসবে।’

আরও পড়ুন

হতবাক-ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী

ওই কিশোরীর বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রামে। আজ বেলা দুইটার দিকে ওই বাড়িতে গিয়ে তার এক বাক্‌প্রতিবন্ধী ভাই ছাড়া পরিবারের অন্য কাউকে পাওয়া যায়নি। পরিবারের অন্য সদস্যরা ঘটনাটি জানার পর গতকাল রাতে লালমনিরহাটে রওনা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রতিবেশী নারীরা। মুঠোফোনে কথা বললে কিশোরীর বাবা জানান, তিনি গাড়িতে রয়েছেন। মেয়ের কাছে যাচ্ছেন।

কিশোরীর বড় চাচা বলেন, তাঁর ছোট ভাই স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে গাজীপুরের জয়দেবপুর নতুন বাজার এলাকায় বসবাস করেন। ভাই (কিশোরীর বাবা) সেখানে শ্রম বিক্রির কাজ করেন। ভাইয়ের স্ত্রী বিভিন্ন মেসে রান্নার কাজ করেন। তাঁদের বড় মেয়ে পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। ছোট মেয়ে বয়স কম হওয়ায় মায়ের সঙ্গে থাকে। অন্যদিকে দুই ছেলে গ্রামের বাড়িতে বসবাস করে। বড় ছেলে পড়াশোনা করে। ছোট ছেলে বাক্‌প্রতিবন্ধী।

সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে আশপাশের বাড়ি থেকে নারী-পুরুষেরা ছুটে আসেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক এক সদস্য (৭০) বলেন, গতকাল তাঁরা এ সংবাদ পান। ট্রেনের একজন অ্যাটেনডেন্ট যে এ ধরনের অপকর্ম করতে পারেন, তা হতবাক ও ক্ষুব্ধ করেছে তাঁদের। এ ধরনের অপরাধী কীভাবে যাত্রীবাহী ট্রেনে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন?

সাবেক জনপ্রতিনিধির মন্তব্য শুনে গ্রামের নারী-পুরুষেরা হাত উঁচিয়ে অভিযুক্ত অ্যাটেনটেন্ডের দ্রুত ও কঠোর বিচারের দাবি জানান। গ্রামবাসী কিশোরীর জন্য সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি জানান।

আরও পড়ুন