রংপুরে মাল্টিমিডিয়ায় শিক্ষার বেহাল চিত্র 

রংপুরের তিন উপজেলার অন্তত ৫০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে মাল্টিমিডিয়া মাধ্যমে শিক্ষার ক্ষেত্রে  দুর্দশার চিত্র দেখা গেছে।

বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে রংপুরের কাউনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কম্পিউটারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম। গত বছরের নভেম্বর মাসে মাল্টিমিডিয়া সরঞ্জামগুলো এসেছিল। গত ৫ মার্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষেছবি: প্রথম আলো

রংপুরের গঙ্গাচড়ার উত্তর বাগপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টিতে দুটি ল্যাপটপ ও একটি প্রজেক্টর দেওয়া হয়েছে; কিন্তু এখানে মাল্টিমিডিয়া মাধ্যমে পাঠদান বন্ধ। কারণ, তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই।

পাশাপাশি মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ–সংকটের কথাও বললেন প্রধান শিক্ষক রেমেনা খাতুন। 

এই বিদ্যালয়ের অদূরে বাগপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ৩২০ শিক্ষার্থীর এ বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ আছে; কিন্তু মাল্টিমিডিয়া মাধ্যমে পাঠদান হয় না তেমন। প্রধান শিক্ষক আনজুমান আরা বলেন, তাঁরা ২০১৪ সালে একটি ল্যাপটপ পেয়েছেন। তবে এটির মনিটর কিছুদিন পরপর নষ্ট হয়। এখন পর্যন্ত নতুন ল্যাপটপ পাননি।

শুধু এ দুই বিদ্যালয় নয়, রংপুর সদর, গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া উপজেলার অন্তত ৫০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে মাল্টিমিডিয়া মাধ্যমে পাঠদানের এমন চিত্র দেখা গেছে।

জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অন্তত ২৫ শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে অন্তত পাঁচটি বড় সংকট। প্রথমত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনোটিতে ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর নষ্ট। দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব। তৃতীয়ত, ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষের অভাব। ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষ থাকলেও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম নষ্ট। কোথাও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পড়ে আছে বাক্সবন্দী হয়ে। চতুর্থত, ইন্টারনেটের ধীরগতি ও পঞ্চমত, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ–বিভ্রাট। 

 প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে শিখন কার্যক্রমকে আনন্দময় ও সহজ করে তুলতে মাল্টিমিডিয়া মাধ্যমে পাঠদানের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। শিশুরাও এ ডিজিটাল মাধ্যমে ক্লাস নিলে উৎসাহিত হয় বলে মত দেন অনেক শিক্ষক।

 জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মাঠপর্যায়ের এ তথ্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে। 

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪১ হাজার ল্যাপটপ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একাধিক মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।

মাল্টিমিডিয়া কার্যক্রম ভালো চলছে। সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা ভালো রিপোর্ট দেন।

মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ নেই

রংপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় এ বছর প্রাথমিকের শিক্ষার্থী পাঁচ লাখের বেশি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১ হাজার ৪৪৪টি। এর মধ্যে পিইডিপি-৩ কর্মসূচির আওতায় ২০১৫-১৮ সালে ১ হাজার ২৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ, স্ক্রিনসহ প্রজেক্টর, রাউটার ও মাল্টিমিডিয়ার অন্যান্য উপকরণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া পিইডিপি-৪ কর্মসূচির আওতায় ৯৫৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত ডিসেম্বরে দেওয়া হয় একটি করে ল্যাপটপ। 

এর মধ্যে গত বছর রংপুর সদরে ১৭১ ও গঙ্গাচড়ায় ১২২ বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ দেওয়া হয়। ল্যাপটপ পাওয়া রংপুর সদরের ৩৪টি বিদ্যালয় ঘুরে জানা গেছে, এগুলোর ২৫টিরই মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ নেই। চারটিতে শিশুশ্রেণির ক্লাসরুম সাজানো হয়েছে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ হিসেবে। প্রজেক্টর নেই ১০টি প্রতিষ্ঠানে। আর প্রজেক্টর নষ্ট পাঁচটিতে। ছয়টিতে নেই আইসিটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক। 

মাল্টিমিডিয়া মাধ্যমে শিক্ষার এই দুর্দশার বিষয়ে রংপুরের সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আতিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, একটি কম্পিউটার দিয়ে পুরো বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শেখানো কঠিন। 

গঙ্গাচড়ার ৩০টি বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে নিয়মিত মাল্টিমিডিয়া মাধ্যমে ক্লাস হয়, এমন একটি প্রতিষ্ঠানও পাওয়া যায়নি। ২২টিতে মাল্টিমিডিয়া মাধ্যমে পাঠদানের শ্রেণিকক্ষ নেই। 

অবশ্য গঙ্গাচড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাগমা শিলভীয়া খান প্রথম আলোকে বলেন, মাল্টিমিডিয়া কার্যক্রম ভালো চলছে। সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা ভালো রিপোর্ট দেন।

প্রথমত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনোটিতে ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর নষ্ট। দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব। তৃতীয়ত, ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষের অভাব। ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষ থাকলেও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম নষ্ট। কোথাও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পড়ে আছে বাক্সবন্দী হয়ে। চতুর্থত, ইন্টারনেটের ধীরগতি ও পঞ্চমত, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ–বিভ্রাট। 

বাক্সবন্দী সরঞ্জাম 

রংপুর সদরের বড়বাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত ২৪ নভেম্বর কম্পিউটারের পাঁচটি মনিটর, সিপিইউ, কি–বোর্ড, মাউসসহ মাল্টিমিডিয়া সরঞ্জাম দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিতে সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কম্পিউটার ও ভাষা ল্যাব নেই।

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক সাঈদ হোসেন বলেন, তাঁদের মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ নেই। ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ ল্যাবের সরঞ্জাম নিজের বাড়িতে রেখেছেন। 

জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) হামিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ২৬২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ল্যাবের সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে। কক্ষ সজ্জিতকরণ, আসবাব ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের সুযোগ আপাতত নেই। 

মাল্টিমিডিয়া কার্যক্রম ভালো চলছে। সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা ভালো রিপোর্ট দেন।
গঙ্গাচড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাগমা শিলভীয়া খান

চালু হয়নি ডিজিটাল ল্যাব 

২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৪ হাজার ১৭৬টি শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তর। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৬০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়। 

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তর, রংপুরের তথ্য বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ জেলায় দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়। ল্যাবে সরবরাহ করা হয় একটি ল্যাপটপ, তিনটি ডেস্কটপ ও মাল্টিমিডিয়া সামগ্রী।

মাল্টিমিডিয়া মাধ্যমে শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা সুস্পষ্ট; কিন্তু বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে অব্যবস্থাপনা দেখা যায়। এই অব্যবস্থাপনা শুধু রংপুরে নয়, সারা দেশে। স্থানীয় পর্যায়ে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারে কতজন শিক্ষক দক্ষ, তারও সঠিক তথ্য নেই। তিনি বলেন, জনগণের করের টাকায় এসব প্রকল্প নেওয়া হলেও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তাই সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী

১২ মে রংপুর শহরের দক্ষিণ মুলাটোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, একটি তালাবদ্ধ কক্ষে ডেস্কটপসহ অন্যান্য সামগ্রী রাখা। বিদ্যালয়টির শিক্ষকেরা বলেন, ল্যাবটি সাত বছরে এক দিনও ব্যবহৃত হয়নি। এ বিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক পাঁচ দিন করে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। শিক্ষক রেহেনা বেগম ও শাহনাজ পারভীন বলেন, এত কম প্রশিক্ষণে ল্যাব পরিচালনা করতে সক্ষম নন তাঁরা। 

মাঠপর্যায়ে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব দেখভাল করে জেলা–উপজেলা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তর।  ল্যাব অচল থাকার বিষয়টি অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন রংপুর জেলা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রোগ্রামার ফারহান নওরোজ নূর।‌

মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষে প্রজেক্টরের স্ক্রিন ঝোলানো; কিন্তু ল্যাপটপ নষ্ট। তাই মাল্টিমিডিয়া মাধ্যমে ক্লাস হচ্ছে না। সম্প্রতি রংপুরের গঙ্গাচড়ার বাগপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষের সরঞ্জাম নষ্ট

‘ইন্টারঅ্যাকটিভ শ্রেণিকক্ষ’ প্রচলনে ২০১৭ সালে একটি পাইলট প্রকল্প নেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পের আওতায় ২০২০ সালে রংপুরের আট উপজেলায় একটি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইন্টারঅ্যাকটিভ হোয়াইট বোর্ড, প্রজেক্টর, সিপিউ, ইউপিএস, সাউন্ড সিস্টেম, সফটওয়্যার ও মনিটর সরবরাহ করা হয়েছে।

২০ মে গঙ্গাচড়ার ঠাকুড়াদহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলে প্রধান শিক্ষক সাজু আহমেদ জানান, তাঁদের নষ্ট ইন্টারঅ্যাকটিভ হোয়াইট বোর্ড ও সিপিইউ দেওয়া হয়েছে। মনিটর ও ইউপিএস কাজ করে না। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও সহকারী প্রকল্প পরিচালককে কয়েকবার অবগত করা হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এতে ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষের আইসিটি উপকরণগুলো অচল পড়ে আছে।

প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক সিরাজুল ইসলাম দাবি করেন, করোনার কারণে তাঁদের পাইলট প্রকল্পটি বাধাগ্রস্ত হয়। তবে তাঁর দাবি, প্রকল্প চলাকালে নষ্ট সরঞ্জাম দেওয়ার সুযোগ নেই।

সার্বিক বিষয়ে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাল্টিমিডিয়া মাধ্যমে শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা সুস্পষ্ট; কিন্তু বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে অব্যবস্থাপনা দেখা যায়। এই অব্যবস্থাপনা শুধু রংপুরে নয়, সারা দেশে। স্থানীয় পর্যায়ে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারে কতজন শিক্ষক দক্ষ, তারও সঠিক তথ্য নেই। তিনি বলেন, জনগণের করের টাকায় এসব প্রকল্প নেওয়া হলেও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তাই সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন।’