নাশকতা মামলায় আসামি মাগুরার মহম্মদপুরের ৫ সাংবাদিক

সাক্ষীরা বলছেন, এমন কোনো ঘটনা সম্পর্কে তাঁরা জানেন না। রাত দুইটার দিকে কয়েকটি শব্দ শুনতে পান। তবে ভয়ে কেউই বাড়ি থেকে বের হননি।

হাতকড়া
প্রতীকী ছবি

মাগুরার মহম্মদপুরে নাশকতার অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা একটি মামলায় পাঁচজন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। ২ নভেম্বর নাশকতা কর্মকাণ্ড ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে মামলাটি করেন মহম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মুস্তাফিজুর রহমান। স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীসহ মামলায় আসামি হিসেবে ১৯৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি ১০০ থেকে ১৫০ জন।

মামলার এজাহারে উল্লেখিত সময়, ঘটনার বর্ণনা ও আসামিদের তালিকা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে। এজাহারে ঘটনার সময় বলা উল্লেখ করা হয়েছে ১ নভেম্বর রাত পৌনে ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। তবে ওই সময় স্থানীয়দের কেউ ঘটনাস্থলের আশপাশে অনেক মানুষের জমায়েত বা ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা দেখেননি।

আসামি পাঁচ সাংবাদিক হচ্ছেন দৈনিক ইত্তেফাক-এর উপজেলা প্রতিনিধি ও প্রেসক্লাব মহম্মদপুরের সহসভাপতি মো. মেহেদী হাসান ওরফে পলাশ, খবরের আলো পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি ও প্রেসক্লাব মহম্মদপুরের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক মো. ওহাব বিশ্বাস, লোকসমাজদৈনিক জনতা পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি মো. তরিকুল ইসলাম তারা, নিউ নেশন পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে রফিক মাস্টার এবং ভোরের দর্পণ পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি ও প্রেসক্লাব মহম্মদপুরের প্রচার সম্পাদক মো. রাসেল মিয়া ওরফে রাসেল মোল্যা।

আমার বয়স এখন ৭৬ বছর। একসময় রাজনীতি করতাম। সেটা প্রায় ৪০ বছর আগে। এখন শুধু সাংবাদিকতা করি। মামলায় আসামির তালিকায় নিজের নাম দেখে বিস্মিত হয়েছি।
প্রেসক্লাব মহম্মদপুরের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক

এর মধ্যে মো. রফিকুল ইসলাম ও মো. তরিকুল ইসলাম সাংবাদিকতার পাশাপাশি শিক্ষকতা করেন। মো. রফিকুল ইসলাম দাবি করেন, ঘটনার দিন তিনি এক আত্মীয়কে ডাক্তার দেখাতে ফরিদপুরে অবস্থান করছিলেন। মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, তিনি ঘটনার দিন যশোরে ছিলেন। মো. ওহাব বিশ্বাস বলেন, ‘আমার বয়স এখন ৭৬ বছর। একসময় রাজনীতি করতাম। সেটা প্রায় ৪০ বছর আগে। এখন শুধু সাংবাদিকতা করি। মামলায় আসামির তালিকায় নিজের নাম দেখে বিস্মিত হয়েছি।’

অভিযোগে বলা হয়েছে, বাদী ১ নভেম্বর রাতে মহম্মদপুর বাজারে টহল দিচ্ছিলেন। রাত পৌনে ১২টার দিকে খবর পান অবরোধ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলের কর্মীরা নাশকতা কর্মকাণ্ড ঘটানোর উদ্দেশ্যে মাগুরা-মহম্মদপুর সড়কে ধোয়াইল আদর্শ নুরানী হাফেজি মাদ্রাসা ও এতিমখানার সামনে জড়ো হয়েছেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে বিএনপি ও সমমনা দলের কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যান। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৭ জনকে আটক করে। জব্দ করা হয় বিস্ফোরিত ও অবিস্ফোরিত ককটেল বোমাসদৃশ কৌটা, জালের কাঠি, বাঁশের লাঠিসহ বিভিন্ন বস্তু।

মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ধোয়াইল গ্রামের মো. হাফিজুর রহমান, মো. বাবুল শেখ ও তাঁর ভাই মো. কাবুল শেখ। গতকাল বৃহস্পতিবার ওই তিনজনসহ স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা সবাই প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। বলেছেন, ওই দিন রাতে তাঁরা বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন। এমন কোনো ঘটনা সম্পর্কে জানেন না। তবে রাত দুইটার দিকে কয়েকটি শব্দ শুনতে পান। তবে ভয়ে কেউই বাড়ি থেকে বের হননি। কিছুক্ষণ পর পুলিশ গিয়ে তাঁদের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে মাগুরা-মহম্মদপুর সড়কে নিয়ে আসেন। সেখানে বিস্ফোরিত ও অবিস্ফোরিত বোমাসদৃশ বস্তু দেখান। পরে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর নেয় পুলিশ। তবে ওই সময় ঘটনাস্থলে পুলিশ ছাড়া অন্য কাউকেই দেখেননি তাঁরা।

মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘রাত আনুমানিক দুইটার দিকে পরপর তিনটি শব্দ শুনতে পাই। ঠিক দুই থেকে তিন মিনিট পরই পুলিশের গাড়ির সিগন্যাল (হুইসেল) শুনতে পাই। আমরা সাধারণ মানুষ, ফলে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। ঘর থেকে না বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। এর কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে আমাদের রাস্তায় ডেকে নিয়ে যায়। আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করে বিএনপির লোকজন এসে বোমা ফুটিয়েছে, দেখেছেন কি না। আমি বলি আমরা ঘরে শুয়ে ছিলাম, এসব কিছু দেখিনি। এর বেশি কিছু জানি না।’

স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার দিন গভীর রাতে মহম্মদপুর থানার পুলিশ কয়েকজন সাংবাদিককে ফোন করে নাশকতা ও বোমা হামলার সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য যেতে বলেছিল। যদিও তাঁরা রাতে কেউ সেখানে যাননি। যাঁদের পুলিশ ফোন করেছিল, তাঁদের একজন প্রেসক্লাব মহম্মদপুরের সভাপতি বিপ্লব রেজা বিকো।

জানতে চাইলে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ১ (নভেম্বর) তারিখ দিবাগত রাত আনুমানিক দুইটার দিকে মহম্মদপুর থানার একজন এসআই ফোন করেন। আমাকে বলা হয় ধোয়াইল পুলিশের গাড়িতে ককটেল চার্জ (বোমা হামলা) হয়েছে। সেখানে সাংবাদিক পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। আমি কয়েকজন সাংবাদিককে ফোন করি। কিন্তু অত রাতে কেউ যেতে পারেননি।’

এক প্রশ্নের জবাবে বিপ্লব রেজা বলেন, ‘এইটা নিয়ে আমরা প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে থানা-পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। ওনারা (পুলিশ) আমাদের বলছেন, ওসি সাহেব নতুন আসছেন, সবাইকে ঠিকমতো চেনেন না। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে (আসামিদের) নাম এসেছে।’

প্রেসক্লাব মহম্মদপুরের সাধারণ সম্পাদক মাহামুদুন নবী বলেন, ‘এজাহারে ঘটনার সময় বলা হয়েছে রাত পৌনে ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা। কিন্তু রাত দুইটার সময় আমাদের সভাপতির কাছে ফোন এসেছে ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। আবার এই মামলায় পেশাদার সাংবাদিকদের কীভাবে আসামি করা হলো, এটাও বোধগম্য নয়।’