বড় ইলিশ কমেছে এ মৌসুমে

মৎস্য বিভাগ এবার ছয় লাখ টন ইলিশ আহরণের আশা করছে। তবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আহরণের যে গতি, তাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শঙ্কা থাকছে।

কক্সবাজার শহরের ফিশারিঘাটে পাইকারি বাজারে ইলিশ
ফাইল ছবি

এ বছর ইলিশের আহরণ কয়েক বছরের তুলনায় কমে গেছে। ছয় বছর ধরে দেশে ইলিশের ওজন ও আকার বাড়লেও এবার সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে। মৎস্যজীবীরা বলছেন, এবার আহরিত ইলিশের অন্তত ৭০ শতাংশের আকার ছোট। এ অবস্থায় দেশে ইলিশ উৎপাদনের ধারাবাহিক অগ্রগতি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

হঠাৎ এবার ইলিশের ওজন ও আকার কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে শরীয়তপুর, চাঁদপুর, কক্সবাজার, ভোলার মনপুরা, বরিশাল ও বরগুনার পাথরঘাটার জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, এবার ইলিশের প্রাপ্যতা গত কয়েক বছরের চেয়ে যেমন কম, তেমনি আকার ও ওজন কম। ফলে মৎস্য বিভাগ এবার ছয় লাখ টন ইলিশ আহরণের আশা করলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আহরণের যে গতি, তাতে এবার সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না–ও হতে পারে।

এবার আমাদের ছয় লাখ টন ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা। এরই মধ্যে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন ইলিশ আহরিত হয়েছে।
মো. আনিছুর রহমান, মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, চাঁদপুর নদীকেন্দ্র

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ইলিশ গবেষক মো. আবদুল ওহাব প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে দেশে ইলিশের উৎপাদন, আকার-ওজন বৃদ্ধির প্রবণতা ছিল, সেখানে হঠাৎ এটা কমে যাওয়ার বিষয়টি দুশ্চিন্তার। এ জন্য ইলিশ ব্যবস্থাপনাসহ সার্বিক বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান ও গবেষণার প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ বাংলাদেশ-২ অ্যাকটিভিটির ইলিশবিজ্ঞানী জলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে আহরিত মাছের মধ্যে বড় মাছ ৬০ শতাংশ ছিল। এখন কমে যাচ্ছে। মৌসুম শেষ বলে এটা হতে পারে। তবে মাঠের চিত্র যদি আমাদের পর্যবেক্ষণের বিপরীত হয়, অর্থাৎ ছোট মাছের হার বেশি হয়, তবে সেটা ভালো লক্ষণ নয়। এটা অতিরিক্ত আহরণের কারণে হতে পারে। তাই এদিকে নজর দেওয়া উচিত।’

মাছ কম থাকায় আমার তিনটি নৌকার একটি নদীতে নামাইনি। সাত লাখ টাকা খরচ করে দুটি নৌকা নদীতে গেছে। এখন পর্যন্ত এক টাকাও লাভের মুখ দেখিনি।
মানিক দেওয়ান, মৎস্যজীবী নেতা, হাইমচর, চাঁদপুর

২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল ৫ লাখ ৮৯ হাজার টন, যা এক দশক আগের তুলনায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, জেলেদের জালে ৮০০ গ্রাম থেকে এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ আহরণের পরিমাণ গত কয়েক বছরে বেড়েছিল। ২০১৯ সালে এ ওজনের ইলিশ ধরা পড়েছিল মোট ইলিশের ২২ শতাংশ। ২০২১ সালে এসে তা বেড়ে ২৫ শতাংশ হয়েছিল। আর ইলিশের গড় আকার ধারাবাহিকভাবে ২৮ সেন্টিমিটার থেকে বেড়ে ৩৭ সেন্টিমিটারে দাঁড়িয়েছিল।

বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৫ শতাংশ বাংলাদেশে আহরিত হয়। ২০১৬ সালের পর দেশে ইলিশের উৎপাদন আশানুরূপ বাড়তে থাকে। সাগর ও নদ-নদীতে ধরা পড়া ইলিশের গড় ওজন ৩৫০ গ্রাম বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল গত মৌসুমেও। মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ইকোফিশের পর্যবেক্ষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সাগর ও নদীতে ধরা পড়া ইলিশের গড় ওজন পাওয়া যাচ্ছিল ৮৫০ থেকে ৯০০ গ্রাম। কিন্তু হঠাৎ এবারের মৌসুমে ইলিশ আহরণ যেমন কমে গেছে, তেমনি প্রচুর ছোট ইলিশ ধরা পড়ছে বলে পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

তবে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাঁদপুর নদীকেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘এবার আমাদের ছয় লাখ টন ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা। এরই মধ্যে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন ইলিশ আহরিত হয়েছে।’

মৎস্য অধিদপ্তর কাগজে-কলমে যে হিসাব দেখাচ্ছে, বাস্তবের সঙ্গে তার মিল কম। চাঁদপুরের হাইমচরের মৎস্যজীবী নেতা মানিক দেওয়ান বলেন, ‘মাছ কম থাকায় আমার তিনটি নৌকার একটি নদীতে নামাইনি। সাত লাখ টাকা খরচ করে দুটি নৌকা নদীতে গেছে। এখন পর্যন্ত এক টাকাও লাভের মুখ দেখিনি।’

ভোলার মনপুরার ট্রলারমালিক নাসির উদ্দীন মাঝি প্রথম আলোকে বলেন, এবার যেসব ইলিশ মেঘনা অববাহিকায় ধরা পড়ছে, তার ৭০ শতাংশই ২৫০ থেকে ৫০০ গ্রামের মধ্যে। বাকি ৩০ শতাংশ ৫০০ গ্রাম থেকে এক কেজির ওপরে। কিন্তু গত কয়েক বছর বড় ইলিশের প্রাপ্যতা ছিল ৭০ শতাংশের বেশি। বরিশালের মৎস্য আড়তদার আশরাফ আলী বলেন, এবার ১০০ মণ ইলিশ মোকামে এলে ৬০ মণই ছোট মাছ। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নদীতে আগে বড় মাছ মিলত। কিন্তু এবার নদীতে মাছ নেই। সাগরে যাঁরা মাছ ধরেন, তাঁরা তিন স্তরের জাল নিয়ে সাগরে যান। এর মধ্যে আড়াই থেকে ৪ সেন্টিমিটার ফাঁসের জালে মাছ ধরায় ছোট-বড় সবই ধরা পড়ছে।

বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, এবার মৌসুমে ইলিশ ধরা পড়েছে কম। বৃষ্টিপাত কম এবং অধিক তাপমাত্রার কারণে এটা হয়েছে।