গোলাগুলি-বিস্ফোরণে কাঁপছে টেকনাফ, সীমান্ত বাণিজ্যে অচলাবস্থা

কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের চৌধুরীপাড়া। প্যারাবনের পর নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নাকপুরা গ্রামে গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। রোববার সকালেছবি: প্রথম আলো

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের উত্তরে বলিবাজার এলাকায় রোববার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আকাশ থেকে মর্টার শেল ও বোমা হামলা চালিয়েছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। স্থলভাগ থেকে পাল্টা আক্রমণ করে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। গোলাগুলি-বিস্ফোরণে এপারে টেকনাফের কয়েকটি ইউনিয়নে ভূকম্পন দেখা দেয়। আতঙ্কে অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেন। তবে দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে থেমে থেমে গোলাগুলি হলেও আকাশে হেলিকপ্টার উড়তে দেখা যায়নি।

এদিকে সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করায় বিপাকে পড়েছেন টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কয়েক শ মানুষ। নাফ নদীর সীমান্তে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ করে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করেন। সংঘাতের কারণে তাঁরা ঘেরে নামতে পারছেন না। এ ছাড়া সীমান্তে সমস্যার কারণে টেকনাফ স্থলবন্দরে ব্যবসা-বাণিজ্যেও অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন

টেকনাফ ও উখিয়ার পাঁচটি ইউনিয়ন হোয়াইক্যং, হ্নীলা, টেকনাফ সদর, সাবরাং ও পালংখালীর বিপরীতে নাফ নদীর ওপারে রাখাইন রাজ্য। উত্তর-দক্ষিণ লম্বা রাজ্যের মধ্যভাগে টেকনাফ পৌর শহরের বিপরীতে মংডু টাউনশিপের অবস্থান। মংডুর পশ্চিমে নাফ নদী, পেছনে (পূর্ব দিকে) আকাশছোঁয়া কালাদান পাহাড়। তিন দিন ধরে মংডু শহরের উত্তর দিকের  কুমিরখালী, বলিবাজার, নাইচাডং, কোয়াচিদং, শিলখালী, কেয়ারিপ্রাং, পেরাংপ্রু গ্রামে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। সেখানে সীমান্তচৌকি দখল ও পুনরুদ্ধার নিয়ে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়ায় আরাকান আর্মি।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, গতকাল শনিবার রাতে আরাকান আর্মি বলিবাজার এলাকায় দেশটির বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) কয়েকটি সীমান্তচৌকিতে হামলা করে এবং একাধিক চৌকি দখলে নেয়। চৌকি পুনরুদ্ধারে আজ দুপুরে আকাশ থেকে হামলা চালায় সরকারি বাহিনী। মংডু টাউনশিপ থেকে হেলিকপ্টার উড়ে উত্তর দিকে বলিবাজারে গিয়ে মর্টার শেল ও বোমা নিক্ষেপ করে আবার মংডুতে ফিরে যাওয়ার দৃশ্য এপার থেকে দেখা যায়।

কাঁপছে টেকনাফ সীমান্ত

নাফ নদীর তীরে নেটং পাহাড়ের নিচে ছোট্ট ঘরে থাকেন গাড়িচালক আলী আহমদ (৪৫)। গভীর রাতে যখন ওপারে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে, তখন তিনি নদীর তীরে এসে দাঁড়িয়ে দেখেন, ওপারের আকাশে আগুনের ফুলকি ও কালো ধোঁয়া উড়ছে। আলী আহমদ বলেন, তিন দিন ধরে মংডু শহরের উত্তরে কয়েকটি গ্রামে সবচেয়ে বেশি বিস্ফোরণ হচ্ছে। আজ দুপুরে বিমান থেকে হামলা করা হয়।

হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, মংডুর দক্ষিণ-পূর্বাংশে রাচিডং-বুচিডং টাউনশিপেও সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির তুমুল সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে। আরাকান আর্মি মংডু শহরকে তিন দিক থেকে ঘিরে হামলা চালাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের পশ্চিম দিকের নাফ নদী অংশের নিয়ন্ত্রণ এখনো সরকারি বাহিনীর হাতে আছে।

আরও পড়ুন

টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, শনিবার সন্ধ্যা থেকে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত মংডুর আশপাশে কয়েকটি গ্রামে ৬০-৭০টি মর্টার শেলের বিস্ফোরণ ঘটেছে। এতে টেকনাফ পৌরসভার জালিয়াপাড়া, চৌধুরীপাড়া, কুলালপাড়া, ডেইলপাড়াতে ভূকম্পন তৈরি হয়। আগের দুই রাতেও একই অবস্থা ছিল। ভূকম্পনের সময় ভয়ে শিশুরা কান্নাকাটি শুরু করে। রাখাইনের এ সংঘাত কখন থামবে, কেউ জানে না।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, মংডুর আশপাশের গ্রামে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটলেও সন্ধ্যা পর্যন্ত টেকনাফ সীমান্তে গুলি এসে পড়ার খবর পাওয়া যায়নি। সীমান্ত এলাকার লোকজনকে নিরাপদ দূরত্বে সতর্ক অবস্থায় থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

বন্ধ আয়রোজগারের পথ

সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করায় টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কয়েক শ মানুষ বিপাকে পড়েছেন। তাঁরা নাফ নদীর সীমান্তে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু সংঘাতের কারণে ঘেরে নামতে পারছেন না
ছবি: প্রথম আলো

টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কয়েক শ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে নাফ নদীর সীমান্তে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। রাখাইনে সংঘাতের কারণে তাঁরা মাঠে নামতে পারছেন না। চিংড়ি ও কাঁকড়া উৎপাদন বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন তাঁরা। রোববার সরেজমিন হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া এলাকা ঘুরে চাষিদের হাহাকার অবস্থা চোখে পড়ে। উলুবনিয়া থেকে মিয়ানমার সীমান্তের দূরত্ব ৩০০-৪০০ ফুট। মাঝে নাফ নদী দুই দেশের সীমানা ভাগ করেছে।

উলুবনিয়ায় ৭৪ একরের পৃথক তিনটি চিংড়িঘের করেন স্থানীয় হারুন রশিদ সিকদার। সীমান্ত পরিস্থিতির কারণে ঘের বন্ধ থাকায় অর্ধশতাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। চিংড়ি পোনার বিপরীতে তাঁর ২৪ লাখ টাকার বিনিয়োগ মাঠে মরে গেছে জানিয়ে হারুন সিকদার বলেন, এই গ্রামের মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে আছেন।

আরও পড়ুন

উলুবনিয়া মৎস্য চাষ সমিতির সভাপতি জাফর আলম বলেন, নাফ নদীর তীরে হোয়াইক্যং, উলুবনিয়া, হ্নীলা, লম্বাবিল, উনচিপ্রাং, বালুখালী, আঞ্জুমানপাড়া, রহমতেরবিল এলাকায় শতাধিক ঘেরে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ বন্ধ আছে। সংঘাত না থামলে আসন্ন রোজায় এসব গ্রামে অর্থসংকট দেখা দেবে।

উখিয়ার পালংখালী ইউপির চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, তাঁর ইউনিয়নে সীমান্তঘেঁষা সাতটি গ্রামের মানুষ ধান-সবজি চাষ করতে সীমান্তে যেতে পারছেন না। এতে হাজারো মানুষ বিপাকে পড়েছেন। এখন পর্যন্ত দরিদ্র কোনো পরিবারে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পৌঁছায়নি।

অচল সীমান্ত বাণিজ্য

সীমান্তে অস্থিরতার কারণে টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। রোববার টেকনাফ স্থলবন্দরে
ছবি: প্রথম আলো

সীমান্তে অস্থিরতার কারণে টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। এক মাস আগেও মিয়ানমার থেকে কাঠ, হিমায়িত মাছ, শুঁটকি, আচার, চাল, ডাল, আদা, মরিচ, শুকনা নারকেল, পেঁয়াজ নিয়ে টেকনাফে দৈনিক ২০-২২টি জাহাজ ও ট্রলার আসত। রাখাইনে সংঘাতের কারণে এখন সাত দিনে তিন থেকে পাঁচটি ট্রলার আসছে।

রোববার দুপুরে টেকনাফ স্থলবন্দরের জেটিঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, একটি কাঠের ট্রলার থেকে আদা, শুঁটকি ও শুকনা নারকেল খালাস করা হচ্ছে। ট্রলারটি এসেছে গত শনিবার রাখাইনের রাজধানী সিথুয়ে (আকিয়াব) থেকে। বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে। নাফ নদীর ওপারে মংডু থেকে গত এক মাসে পণ্য নিয়ে কোনো ট্রলার আসেনি।

আরও পড়ুন

টেকনাফে আমদানি পণ্য নিয়ে আসা মিয়ানমারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, কয়েক দিন ধরে রাখাইনের রাজধানী সিথুয়ে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র লড়াই হচ্ছে। রাজধানী ইয়াঙ্গুন-সিথুয়ে যাতায়াতকারী সড়কের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছে আরাকান আর্মি। সেখানকার পোন্নাগিউনে পুলিশের একটি ফাঁড়ি দখলে নিয়েছে। আরাকান আর্মি সিথুয়ে ও মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাদের রুখতে সরকারি বাহিনী বিমান হামলার পাশাপাশি ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছে। পরিস্থিতি দিন দিন জটিল আকার ধারণ করছে।

স্থলবন্দর পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট টেকনাফ লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রাখাইনে চলমান সংঘাতের কারণে বন্দরের ৭০ শতাংশ ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। অবশিষ্ট ব্যবসাও বন্ধ হওয়ার পথে। বন্দরে আগে দৈনিক এক হাজার শ্রমিক মালামাল খালাসের কাজ করতেন। এখন ২৫০ জন কাজ করছেন। অন্যরা বেকার হয়ে পড়েছেন।