সাইকেলে করে ছোলা বিক্রিতেই আনন্দ আবদুর রশিদের, চলে সংসারও

১৬ বছর ধরে খুলনা শহরে সাইকেল নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছোলা বিক্রি করছেন আব্দুর রশিদ
ছবি: প্রথম আলো

বাইসাইকেলের হাতলের দুই পাশে রাখা দুটি ব্যাগ। একটির মধ্যে বোতলভর্তি পানযোগ্য পানি ও অন্যটিতে বিভিন্ন মসলার পাত্র। হাতলের উঁচু চিকন রডের সঙ্গে বাঁধা একটি বাল্ব ব্যাটারির সাহায্যে জ্বলছে। ব্যাটারিটিও বিশেষ কায়দায় আটকে রাখা হয়েছে সাইকেলের সঙ্গে।

মাঝবরাবর রডের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা মাঝারি আকারের অ্যালুমিনিয়ামের ডেক, যার মধ্যে রাখা ছোলা ভুনা। এর নিচে মাটির ছোট্ট চুলায় জ্বলছে কাঠ। অল্প আঁচে গরম রাখা হচ্ছে ছোলা।

সাইকেলের পেছনের অংশে বাঁধা একটি ছোট বালতি। এতে বিভিন্ন উপকরণ। অ্যালুমিনিয়ামের ডেকের ঢাকনার ওপর রাখা কয়েকটি মেলামাইনের পিরিচ ও একবার ব্যবহারোপযোগী গ্লাস।

প্রায় ১৬ বছর ধরে এভাবে প্রতিদিন সাইকেলে ঘুরে ঘুরে ছোলা বিক্রি করেন পঞ্চাশোর্ধ্ব মো. আবদুর রশিদ। চুইঝাল, আলু ও আস্ত রসুন দিয়ে রান্না করা এ ছোলার স্বাদ অনন্য। আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে সাইকেল নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছোলা বিক্রি করাতেই আনন্দ পান। অন্য কাজের চেয়ে এতে পরিশ্রমও কম। যা আয় হয়, তাতে সংসার খরচ উঠে যায়।

রাত আটটার দিকে আবদুর রশিদের সঙ্গে দেখা হয় খুলনা নগরের বিআইডব্লিউটিএর ৪ নম্বর ঘাট এলাকায়। সেখানে দাঁড়িয়ে ছোলা বিক্রি করছিলেন তিনি। ততক্ষণে ডেকের ছোলা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।

ক্রেতাদের গ্লাস ও পিরিচে ছোলা সরবরাহ করছিলেন আবদুর রশিদ। তাঁর ছোলার দুটি প্যাকেজ রয়েছে। একটি ১০ টাকা ও অন্যটি ১৫ টাকা। ১৫ টাকার ছোলার সঙ্গে একটি আস্ত রসুন থাকে। সঙ্গে কুচি কুচি করে কাটা শসা ও বিভিন্ন ধরনের মসলা মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়।

আবদুর রশিদের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলায়। বর্তমানে থাকেন নগরের নূর নগর এলাকার বিশ্বাসপাড়ায় ভাড়া বাড়িতে। প্রায় ২২ বছর আগে কাজের সন্ধানে খুলনায় আসেন। প্রথম দিকে রিকশা চালাতেন। পরে নৈশ্যপ্রহরীর চাকরি নেন। স্বল্প বেতনে সংসার চলত না, রাত জাগার কষ্টও বেশি। পরে বৈকালি এলাকার এক ব্যক্তির কাছ থেকে ধীরে ধীরে ছোলা রান্না শিখে নেন। এর পর থেকে প্রায় ১৬ বছর ধরে সাইকেল নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছোলা বিক্রি করছেন।

আবদুর রশিদ বলেন, ‘এলাকায় কোনো কাজ ছিল না। অভাবের সংসারে কাজের সন্ধানে খুলনায় আসি। প্রথম দিকে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। ছোলা বিক্রিতে কষ্ট তুলনামূলক কম।’

প্রতিদিন দুপুরে ছোলা রান্না করে রাখেন। বিকেলে আসরের নামাজ পড়ে সাইকেল নিয়ে বের হন। নূর নগর এলাকা থেকে হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেটের সামনে দিয়ে পাওয়ার হাউস মোড় হয়ে বিআইডব্লিউটিএ ঘাট এলাকায় চলে আসেন। যেদিন ওই এলাকায় ক্রেতার চাপ কম থাকে, সেদিন চলে যান বড় বাজার এলাকায়।

প্রতিদিনই সব ছোলা বিক্রি হয়ে যায় আবদুর রশিদের। সবচেয়ে বেশি চার কেজি ছোলা বিক্রি হয় শুক্রবার। এদিন রাস্তাঘাটে লোকজন বেশি থাকে, এ কারণে বিক্রিও বেশি। অন্য দিনগুলোয় বিক্রি হয় দুই থেকে আড়াই কেজি ছোলা। সাধারণত রাত নয়টার মধ্যে বিক্রি শেষ হয়ে যায়। এরপর বাড়ি ফেরেন। আবদুর রশিদ বলেন, দিন শেষে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মতো লাভ থাকে। আগে লাভ বেশি থাকত। তবে এখন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় কম থাকে।

আবদুর রশিদের তিন ছেলে। বড় ছেলে মাদ্রাসায় হাফেজি পড়ছেন, মেজটি এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে আর ছোটটি পড়ছে দশম শ্রেণিতে। অভাবের সংসার হলেও সন্তানদের কাউকে কাজ করতে দেন না ক্ষুদ্র এই ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, নিজে খুব বেশি পড়াশোনা জানেন না, তাই ছেলেদের উচ্চশিক্ষিত করার ইচ্ছা রয়েছে তাঁর।

অনেক আগে এলাকা ছাড়লেও নাড়ির টানে মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়ি যান আবদুর রশিদ। সেখানে তাঁর মা ও তিন ভাই থাকেন। বাবা মারা গেছেন অনেক আগে। তিন–চার মাস পরপর মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসেন। আবদুর রশিদ বলেন, ‘মনটা পড়ে থাকে বাড়িতে মায়ের কাছে। কিন্তু এলাকায় কোনো কাজ নেই—তাই খুলনায় থাকা। দিন শেষে যে টাকা আয় হয়, তা দিয়ে আল্লাহর রহমতে মোটামুটি দিন কেটে যায়।’