অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে চিকিৎসা

বদলানো হয় না বিছানার চাদর। মেঝেতে ধুলার স্তর। শৌচাগারে গেলে দমবন্ধ অবস্থা হয়। পুরো হাসপাতালই নোংরা।

মেঝে ও সিঁড়িতে ধুলার স্তর। ব্যবহৃত টিস্যু, মাস্ক, কাগজের টুকরা, ফলের খোসার ছড়াছড়ি। দেয়ালে কফ, থুতু ও পানের পিকের ছোপ। গোসলখানা, শৌচাগারগুলো নোংরা। শয্যার চাদরগুলোও অপরিচ্ছন্ন। উড়ছে মশা-মাছি। এ চিত্র গাজীপুরের টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের। প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাব ও কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকি না থাকায় হাসপাতালটিতে এমন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

হাসপাতালের নোংরা পরিবেশে কী ক্ষতি হয়, জানতে চাওয়া হয়েছিল জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেনের কাছে। তিনি বলেন, হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর রোগীর সুস্থতা অনেকাংশ নির্ভর করে। কোনো কারণে হাসপাতালের পরিবেশ দূষিত হলে রোগীর শ্বাসতন্ত্র ও কিডনি আক্রান্ত হতে পারে। এ ছাড়া যক্ষ্মা, কলেরা, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি খুবই জরুরি।

হাসপাতালটি ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট। বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ ও অন্যান্য বিভাগ মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ হাজার ৫০০ জন মানুষ চিকিৎসা নিতে আসেন। সম্প্রতি হাসপাতালটিতে গিয়ে প্রচুর মানুষের ভিড় দেখা যায়। মূল ফটক পেরিয়ে হাসপাতালটিতে ঢুকতেই দেখা যায়, প্রতিটি সিঁড়ি ও মেঝেতে ধুলার স্তর। পড়ে আছে ব্যবহৃত টিস্যু, মাস্ক, কাগজের টুকরো বা অন্যান্য ময়লা। অনেকটা একই অবস্থা ওয়ার্ডের ভেতরও। লোহার তৈরি বেড, ওষুধ রাখার ট্রেতেও পড়েছে মরিচা ও ময়লার দাগ।

হাসপাতালে মানুষ আসে সুস্থ হইতে। কিন্তু এইহানে যে পরিবেশ, তাতে উল্টা অসুস্থ হওয়ার দশা হইসে।
মো. হারুন, রোগীর স্বজন

ওয়ার্ডের গোসলখানা ও শৌচাগারগুলো বেশি অপরিষ্কার। শৌচাগারগুলোর সামনে রাখা হয়েছে ডাস্টবিন। ময়লা ঠিকমতো পরিষ্কার না করায় চারপাশে দুর্গন্ধ ছড়াছে। সেখান থেকে উড়ছে মশা-মাছি। শৌচাগারের ভেতরটা স্যাঁতসেঁতে। কোনো শৌচাগারে নেই বৈদ্যুতিক বাতি। শৌচাগারগুলো ব্যবহার করতে গিয়ে রোগীরা পড়েন বিড়ম্বনায়। রোগী ও স্বজনদের দাবি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উদাসীন। পরিচ্ছন্নকর্মীরা দিনে একবার এসে কোনোরকমে মেঝে পরিষ্কার করে দিয়ে যান। এরপর আর কোনো খবর থাকে না। এতে ধুলা, মাছি, ময়লা-আবর্জনায় সারাক্ষণই ভোগান্তি পোহাতে হয় তাঁদের।

টঙ্গীর মাছিমুর এলাকা থেকে আসা এক রোগীর স্বজন মো. হারুন বলেন, ‘হাসপাতালে মানুষ আসে সুস্থ হইতে। কিন্তু এইহানে যে পরিবেশ, তাতে উল্টা অসুস্থ হওয়ার দশা হইসে। কোনোকিছুই ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না। বাধ্য হইয়্যা নিজেরাই মেঝে পরিষ্কার করি। কিন্তু বাথরুমে (শৌচাগার) গেলে দম বন্ধ হইয়্যা আসে।’

কথা হয় ইকবাল হোসেন নামে এক রোগীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ভর্তির সময় হাসপাতাল থেকে যে বিছানা চাদর দেওয়া হয়েছে, এক দিন পরেই তা নোংরা হয়ে যায়। এরপর ওয়ার্ডের নার্সদের বহুবার বলার পরও তা পরিবর্তন করা হয়নি। পরে বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে চাদর কিনে আনেন ইকবাল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একজন চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতাল পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি প্রতিদিন অন্তত একবার বিছানা চাদর পরিবর্তন করার কথা। চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীর সুস্থতার জন্য এটা খুবই জরুরি। কিন্তু এখানে তা যথাযথভাবে হতে দেখা যায় না। আমরা প্রায়ই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বলি, কিন্তু কাজ হয় না।’

একজন সরকারি সুইপারসহ হাসপাতালটির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কাজের জন্য আউটসোর্সিং কর্মচারী আছেন প্রায় ৬২ জন। আট ঘণ্টা করে মোট তিন শিফটে কাজ করেন তাঁরা। এরপরও হাসপাতালটি থাকে অপরিচ্ছন্ন। কর্মীদের বেশির ভাগই কাজে ফাঁকি দেন বলে অভিযোগ। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না।

হাসপাতালের দীর্ঘদিনের পুরোনো একজন কর্মকর্তা বলেন, চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে রোগী, নার্স বা চিকিৎসকের ব্যক্তিগত সুরক্ষার পাশাপাশি পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতা ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির সুরক্ষায় হাসপাতালে একটি কমিটি থাকার কথা। অর্থাৎ একটি কার্যকর কমিটির মাধ্যমে বিষয়গুলো সব সময় তদারক করার কথা। কিন্তু হাসপাতালটিতে এ ধরনের কোনো কমিটি নেই। ফলে এখানে যে যার মতো চলে। কেউ কাজ করে, আবার কেউ করে না। ফলে হাসপাতালটিও অপরিচ্ছন্ন থেকে যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালের পাশের রাস্তায় (ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক) সংস্কার কাজ চলছে। তাই ধুলা উড়ে এসে হাসপাতাল অপরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। রাস্তার কাজ শেষ হয়ে গেলে এই সমস্যা আর থাকবে না। আর বিছানার চাদরের কিছুটা ঘাটতি আছে। তবে দীর্ঘদিন না পাল্টানোর বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান জাহাঙ্গীর।’ তদারক কমিটির বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক বলেন, ‘আমাদের আগে কমিটি ছিল। কিছু ডাক্তার ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ায় এখন আবার রিভিউ করা হবে। তবে সব কমিটিই আছে।’