‘সবকিছুর দাম বাড়তে বাড়তে এমন হইছে, ৫০০ টেহা এহন কোনো টেহাই না’

নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার হাইরমারা এলাকার দিনমজুর রেহেনা বেগম
ছবি: প্রথম আলো

সোমবার সকাল ৭টা। নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঢাকাগামী ট্রেনের অপেক্ষায় কয়েক শ মানুষ। তিতাস কমিউটার ট্রেনটি এসে থামামাত্র হুড়োহুড়ি করে তাঁরা উঠলেন। সেই সঙ্গে নেমেও এলেন কিছু মানুষ। তাঁদেরই একজন রেহেনা বেগম (৪২)। নেমেই তিনি হন হন করে ছুটলেন স্টেশনের প্রবেশমুখে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন আরও জনাপঞ্চাশেক নারী-পুরুষ।

নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনের প্রবেশমুখের ওই স্থানে প্রতিদিন ভোর থেকে নানা দিকের শ্রমিকেরা এসে জড়ো হন। তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন শ্রম কিনতে আসা ব্যক্তিদের। নির্মাণসংশ্লিষ্ট শ্রম ছাড়াও মালিকের চাহিদামতো যেকোনো কাজে শ্রম দিতে রাজি তাঁরা। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা ৫ মিনিট পর্যন্ত শ্রমের বিনিময়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পান। তবে প্রতিদিন সবাই যে কাজ পান এমন নয়, কাজ না পেয়ে অনেকে ফিরেও যান।

সেখানে দাঁড়িয়েই রেহেনা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, রায়পুরা উপজেলার হাইরমারা এলাকায় তাঁর বাড়ি। স্বামী রব মিয়া পেশায় কাঠমিস্ত্রি। তবে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে ১০ বছর ধরে ভারী কাজ করতে পারেন না, করলে আয়ের দ্বিগুণ টাকার ওষুধ খেতে হয়। তাই রেহেনা বেগমই উপার্জনের ভার কাঁধে তুলে নিয়েছেন। প্রতিদিনই ভোরে কাজের আশায় এখানে আসেন, কোনো দিন পান আবার কোনো দিন পান না। যেদিন কাজ পান না, সেদিন তাঁকে দোকানে বাকি বা ধার করতে হয়। মাসে গড়ে ১৫ দিন কাজ পান, উপার্জন হয় সাত–আট হাজার টাকার মতো।

রেহেনা বেগম মনে করেন, গরিব হয়ে যেহেতু জন্মেছেন, কষ্টে তো থাকতেই হবে। তাঁর মতো কত মানুষ এমন কষ্টে আছেন। ওই হিসেবে তিনি ভালোই আছেন।

এই টাকায় ঠিক মতো সংসার চলে না রেহেনা বেগমের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো রকমে খাইয়া না খাইয়া আছি। কষ্ট কইরাই চলতে অয়। আর কী করন যাইব? ৩০০ টেহায় পাঁচ কেজি চাল কিনলে আমগর তিন-চার দিন যায়গা। মাংস-ডিমের কতা কইয়া লাভ নাই। মুরগির মাংস এহন ২০০ টেহা কেজি। ছোট মাইয়্যাডার মুহের দিকে চাইয়া মাসে একবার মুরগির মাংস কিনতে অয়। ঈদের সময় বড়লোকরা কোরবানির মাংস দেয় বলে বছরে দুয়েক দিন গরুর মাংস খাইতে পারি। বাজারে তেল, মরিচ, পেঁয়াজ, তরকারি সবকিছুরই দাম এহন খুব বেশি। সয়াবিন তেল পর্যন্ত ২০০ টেহা কেজি (লিটার)। হাজার টেহা লইয়া বাজারে গেলেও অনেক কিছু না কিননাই ফেরত আইতে অয়। সপ্তাহে একবার মাছ অথবা ডিম আর মাসে একবার মুরগির মাংন কিনি। বাকি সময়ডা ডাইল-ভাত খাইয়া আছি।’

রেহেনা বেগমের দুই মেয়ে। ‘ভালো ছেলে’ পাওয়ায় নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ১৩ বছর বয়সী বড় মেয়েটিকে গত বছর বিয়ে দিয়েছেন। এই বিয়ের জন্য স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে ঋণ করেছেন ৪০ হাজার টাকা। এ বছর মেয়েটির একটি ছেলে জন্মের পর মারা গেছে। অভাবের কারণে ছোট মেয়ে এখন আর স্কুলে যায় না। আরও কিছু টুকটাক ঋণ আছে। রেহেনা বেগম বলছিলেন, কীভাবে যে এই ঋণ শোধ করবেন, সেই চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না তাঁর।

রাইতে লাকড়ির চুলাতে রান্না করা ভাত-তরকারি লগে কইরা লইয়া আয়ি, যাতে দুপুরের খাবারের টেহা বাঁচে। এইতা দুঃখের কথা আরও আছে, কইয়া আর কি অইব।
রেহেনা বেগম, দিনমজুর

কথা বলতে বলতে পৌনে ৮টা বেজে যায়। কাজ পেয়ে যান রেহেনা বেগম। আরও কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে নরসিংদী শহরের বৌয়াকুরের নির্মাণাধীন একটি বিপণিবিতানে ইট-সুরকি তুলে দেওয়ার কাজে রওনা হলে এই প্রতিবেদকও তাঁর পিছু নেন। হেঁটে যেতে যেতে রেহেনা বেগম বলেন, ‘কাইলকা কাজে গিয়া ৫০০ টাকা পাইছিলাম। ৩০০ টেহায় ৫ কেজি চাইল আর ২০০ টেহায় এক কেজি (লিটার) সয়াবিন তেল কিনছি। টেহা শেষ হইয়া যাওয়ায় আর কোন তরিতরকারি কিনতে পারছি না। এত কিপ্টামি কইরাও মাসে তিন কেজির কম তেলে অয় না। বাইরে কাজ করার লাইগা বাড়িত শাকসবজিও চাষবাস করতারি না। এগুলোও বাজার থাইক্যা কিনতে অয়।’
কাজের জায়গায় পৌঁছানোর পর রেহেনা বেগম তাঁর স্যান্ডেল দেখিয়ে বলেন, ‘দশ-বারো দিন আগে স্যান্ডেলটা ছিঁড়া গেছে। পরে ১০ টেহা দিয়া সেলাইয়া লইছি। একজোড়া স্যান্ডেল যে কিনমু, হেই টেহাও হাতে নাই। রাইতে লাকড়ির চুলাতে রান্না করা ভাত-তরকারি লগে কইরা লইয়া আয়ি, যাতে দুপুরের খাবারের টেহা বাঁচে। এইতা দুঃখের কথা আরও আছে, কইয়া আর কি অইব।’

জীবনের এসব সমস্যা-সংকটের কথা মানুষকে বলে খুব একটা লাভ নেই বলে মনে করেন রেহেনা। মুখে হাসি এনে তিনি বলেন, মেম্বার-চেয়ারম্যান কারও কাছ থেকেই তেমন সহযোগিতা পাননি। গরিব হয়ে যেহেতু জন্মেছেন, কষ্টে তো থাকতেই হবে। তাঁর মতো কত মানুষ এমন কষ্টে আছেন। ওই হিসেবে তিনি ভালোই আছেন। সবকিছুকে সহজ করে মানিয়ে নেওয়ার মতো সহজাত শক্তি তাঁর আছে। তাই বলেই হয়তো তিনি মুখে হাসি এনে ‘ভালো আছি’ বলতে পারেন।

গত পাঁচ বছরে আগের চেয়ে মজুরি কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু সংসার ঠিকমতো চলে না রেহেনার। তাঁর ভাষায়, ‘আগে টেহা কিছু কম আয় করলেও এত অভাব আছিল না, সংসার মোটামুটি চলছে। আগে ৫০০ টেহায় অনেক কিছু কেনা যাইত, তবে এহন সবকিছুর দাম বাড়তে বাড়তে এমন হইছে, ৫০০ টেহা এহন কোন টেহাই না।’

আটটা বাজে। এখনই তাকে কাজে নেমে পড়তে হবে। এরই মধ্যে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছেন সহকর্মী শ্রমিকেরা। রেহেনা বেগম হাসিমুখে বিদায় দিলেন। এরপরই ঘুরে নির্মাণাধীন বিপণিবিতানটির ভেতরে চলে গেলেন। শুধু বললেন, ‘আমার জন্য দোয়া কইরেন।’