গোল খেয়ে ব্রাজিল–ভক্ত বললেন, ‘আজ বোধ হয় আর হলে থাকা হবে না’

ব্রাজিলের জালের ম্যাচের শেষ মুহূর্তে ক্যামেরুনের গোলের পর এক সমর্থকের অভিব্যক্তি। গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাতে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেছবি: সাদ্দাম হোসেন

খেলার যোগ করা সময়ে ভিনসেন্ট আবুবকরের হেড ব্রাজিলের জাল খুঁজে নেওয়ার পরই উল্লাসে মেতে ওঠে ক্যামেরুন। সেই উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) চত্বরেও। আফ্রিকার দেশটির নাম ধরে মুহুর্মুহু চিৎকার চলতে থাকে। খেলা দেখতে বসা ব্রাজিলের সমর্থকদের চোখে তখনো অবিশ্বাস। তাঁদের কাছে হারের হতাশার চেয়ে তখন যেন বড় হয়ে ওঠে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের তির্যক বাক্যবাণ সামলানোর বিষয়টি। কুয়েটের বস্ত্রকৌশল বিভাগের ইমন যেমন তাঁর বন্ধুকে বলছিলেন, ‘আজ লাক (ভাগ্য) আমাদের সঙ্গে নেই। ওদের যে আনন্দ উল্লাস দেখছি, আজ বোধ হয় আর হলে থাকা হবে না।’

ব্রাজিলের সমর্থক ইমনের রাতটা কেমন কেটেছে, তা আর জানা হয়নি। তবে খেলা শেষে আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা গানের তালে তালে নেচেছেন, উল্লাস করেছেন। আর ব্রাজিলের সমর্থকদের উদ্দেশ্য করে চিরাচরিত খোঁচা তো ছিলই। যেটার ভয় পাচ্ছিলেন ইমনরা।

কুয়েটে এবার বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার বড় আয়োজন করা হয়েছে স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারে। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আশপাশের এলাকার অনেকে এখানে খেলা দেখেন। অর্গানাইজেশন অব কুয়েট স্পোর্টসের (ওকেএস) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রকল্যাণ পরিষদ বড় পর্দায় খেলা দেখার এই ব্যবস্থা করেছে।

পরে এলে ভালো জায়গা পাওয়া নিয়ে সমস্যা হয়, তাই অনেকেই খেলা শুরুর ঘণ্টা দেড়েক আগেই হাজির হয়েছিলেন ছাত্রকল্যাণ কেন্দ্রে। দুই বন্ধু ইমতিয়াজ হোসেন ও তামিম হোসেন সেই দলের। সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করা দুই বন্ধু এসেছেন কুয়েটের পাশের জাব্দিপুর আর মহেশ্বরপাশা থেকে। তামিম হোসেন বলেন, ‘এলাকাতেও বড় পর্দায় খেলা দেখার ব্যবস্থা আছে। তবে এখানে খেলা দেখে মজা হয়। অনেক মানুষ থাকে। দুই পক্ষের লোকজন থাকে। খেলার প্রত্যেক মুহূর্ত উপভোগ করা যায়। যাঁরা আজ ব্রাজিলের সমর্থক নন, দেখবেন তাঁরা ক্যামেরুনের জন্য গলা ফাটাবে।’

খেলা শুরুর আগেই ভরে যায় ছাত্রকল্যাণ কেন্দ্রের নিচতলা, দোতলা আর বাইরে থাকা সব চেয়ার। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জার্সি, পতাকা তো আছেই। অনেকের সঙ্গেই বাঁশি, ভুভুজেলা। টিভি ক্যামেরায় যখনই নেইমারকে দেখানো হচ্ছিল করতালি আর চিৎকারে ফেটে পড়ছিল মিলনায়তন। ব্রাজিল বা ক্যামেরুন যেই আক্রমণে যাচ্ছিল পর্দায় সামনে হলেও তীব্র সমর্থন দিচ্ছিলেন দর্শকেরা।

খেলাকে কেন্দ্র করে ছাত্রকল্যাণ কেন্দ্রের মধ্যের নাশতার দোকানেও বিক্রিবাট্টাও জমজমাট হয়েছে। ‘ক্যাফে কুয়েট’ নামের ওই দোকানের বিক্রয়কর্মী মো. রাজু বলেন, খেলার জন্য বিক্রি বাড়ছে। আগে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে বন্ধ করতেন দোকান। এখন রাত তিনটায় খেলা শেষ হওয়ার পর বন্ধ করেন। সব মিলিয়ে বেশ জমজমাট।

কুয়েটে এবার বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার বড় আয়োজন করা হয়েছে স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারে। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আশপাশের এলাকার অনেকে এখানে খেলা দেখেন
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

প্রকৌশল বিদ্যায় পড়াশোনার চাপ থাকলেও বিশ্বকাপ দেখার মজা বাদ দিতে চান না কুয়েটের শিক্ষার্থীরা। ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শিহান খান বলেন, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনার অনেক চাপ থাকে। সময়ের অপচয় তেমন কেউ করতে চান না। আবার কুয়েটে বেশির ভাগ বিভাগের পরীক্ষা জানুয়ারিতে। তারপরও অন্তত বড় দলের ম্যাচগুলো কেউ মিস করতে চান না।

শিহানের বন্ধু মেহেদী হাসান বলেন, খেলা নিয়ে কুয়েটে উন্মাদনা অনেক। খেলা শেষে মিষ্টি বিতরণ হয়, আনন্দমিছিল হয়। কমন রুমের চেয়ে এখানে খেলা দেখাটা বেশি মজার। এখানে অনেক মানুষ থাকায় উন্মাদনাটা আরও উপভোগ করা যায়।

এই দুই বন্ধু ব্রাজিলের সমর্থক। তাঁরা মনে করেন এবার ব্রাজিল অনেক গোছালো দল, ভালো আক্রমণভাগের সঙ্গে জমাট রক্ষণভাগও আছে। তবে নেইমারের অনুপস্থিতিতে বেশ চিন্তিত তাঁরা।

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিক প্রকৌশল (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী অমর একুশে হলের এ এস এম কাওসার আর্জেন্টিনার সমর্থক। তিনি জানালেন, ব্রাজিল–ক্যামেরুন ম্যাচে তাঁর সমর্থন থাকবে ক্যামেরুনের দিকে। কাওসার বললেন, ‘কুয়েটে আমার প্রথম বিশ্বকাপ দেখা এটা। আর কাতারের এবারের বিশ্বকাপ একের পর এক চমকে ঠাসা। নানা অঘটন ঘটছে। অনেকের অনেক ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো কিছুই মিলছে না।

হলগুলোতেও উন্মাদনা আছে। ক্যাম্পাসে ব্রাজিল–আর্জেন্টিনার সাপোর্টাররাই সবচেয়ে বেশি। যখন ব্রাজিলের ম্যাচ হয়, তখন আর্জেন্টিনার সমর্থকরাও আসেন। তর্ক বিতর্ক হয়। যেমন আজ ব্রাজিলের খেলা দেখতে আমরা হাজির হয়ে গেছি। এটাই বিশ্বকাপের মজা। আবার আমরা ভাবতাম আমরা যে এত উন্মাদনা দেখাই, দলগুলো তো জানতে পারে না। এখন দেখছি, না—কোচ বা খেলোয়াড়েরা আমাদের সমর্থনের কথা জানেন।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের জিহাদ কবীরের কাছে এবারের বিশ্বকাপের প্রযুক্তিগুলো ভালো লাগছে। তিনি বলেন, ‘কাতার বিশ্বকাপটাই আসলে অন্য রকম। ফুটবলে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। সেমি অটো অফসাইড, গোললাইন টেকনোলজি এগুলো অনেক বেশি আপডেটেড।’

খেলার একেবারে শেষ মুহূর্তে হাতে থাকা মুঠোফোনে বারবার চোখ রাখছিলেন ব্রাজিলের সমর্থক মারুফ। ব্রাজিল গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হতে পারছে কি না, তা জানতে গ্রুপের অন্য দুই দল সার্বিয়া-সুইজারল্যান্ড ম্যাচের ফলাফলের দিকে নজর ছিল তাঁর। পাশ থেকে তাঁর আর্জেন্টিনার সমর্থক বন্ধুর টিপ্পনী-’ কি মামা, পরের রাউন্ডের জন্য ক্যালকুলেটর শুধু আমাদের না, তোমাদেরও তো লাগে। এভাবে ৪৩ নম্বর দলের কাছে হেনস্তা হতে হচ্ছে।’ ফোন থেকে চোখ না তুলেই মারুফ বললেন, টেনশন নিও না, সামনে দেখা হবে।’