শহিদুল নিজ খরচে তিন কিলোমিটার সড়কে লাগিয়েছেন ১৪০০ তালগাছ

রাজশাহীর বাগমারার একটি সড়কের তিন কিলোমিটারজুড়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ তালগাছ। গাছগুলো লাগিয়েছেন শহিদুল ইসলাম (৪২)। তিনি একটি স্কুলের ল্যাবে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন।

রাজশাহীর বাগমারার একটি সড়ক ভবানীগঞ্জ-বান্দাইখাঁড়া। এই সড়কের ডালানিতলা থেকে ছোটকয়া পর্যন্ত তিন কিলোমিটারজুড়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ তালগাছ। গাছগুলো লাগিয়েছেন শহিদুল ইসলাম (৪২)। তিনি একটি স্কুলের ল্যাবে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন।

শহিদুল ইসলামের বাড়ি উপজেলার বড় বিহানালী ইউনিয়নের মুরারীপাড়া গ্রামে। তিনি বড় বিহানালী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে কাজ করেন। জানালেন, কিছু পাওয়ার জন্য নয়; বরং সড়কের ক্ষতি ঠেকানো, বজ্রপাত থেকে রক্ষা, সৌন্দর্য বাড়ানো ও দুর্ঘটনা রোধে গাছগুলো লাগিয়েছেন।

শুরুর দিনগুলো

২০১০ সালের কথা। তালগাছ রক্ষার জন্য কিছু করার তাগিদ থেকে শহিদুল ইসলাম তালের আঁটি (বীজ) সংগ্রহ করতে শুরু করেন। তালের মৌসুমে এলাকায় প্রচার করেন, কেউ যেন রস নেওয়ার পর বীজ ফেলে না দেন, তিনি এগুলো কিনে নেবেন। এভাবে বিভিন্ন গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে তিনি তালবীজ সংগ্রহ করেন। প্রতিটি বীজ তিনি এক থেকে দুই টাকায় কিনে নেন। এভাবে প্রায় দুই হাজার বীজ সংগ্রহ করেন তিনি।

দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে সন্তানের মতোই পরিচর্যা করে গাছগুলো বড় করেছেন শহিদুল।
কলেজশিক্ষক ফরিদ উদ্দিন

শহিদুল ইসলাম বীজগুলো সড়কের দুই পাশে লাগানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁর আগ্রহের কথা শুনে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) তখনকার চেয়ারম্যান প্রয়াত রফিকুল ইসলাম রাজি হন। তখন শহিদুল সড়কের দুই পাশে ১ হাজার ৭০০টি তালবীজ রোপণ করেন।

রাজশাহীর বাগমারার ভবানীগঞ্জ-বান্দাইখাঁড়া সড়কের ডালানিতলা থেকে ছোটকয়া পর্যন্ত তিন কিলোমিটারজুড়ে শহিদুলের লাগানো তালগাছ।
ছবি: প্রথম আলো

সরেজমিনে একবেলা

৮ ডিসেম্বর সরেজমিনে দেখা গেল, সড়কের দুই পাশে শহিদুলের লাগানো তালগাছ। তিনি বীজগুলো মাটিতে পুঁতে রাখার পর থেকে নিয়মিত নজর রাখেন। চারা হওয়ার পর নজরদারি বেড়ে যায়। গরু-ছাগল যাতে চারা গাছ নষ্ট না করে, সে ব্যবস্থা করেন। চারা গজানোর পর কোনো সমস্যা হলে সেগুলোর বিশেষ পরিচর্যা করা হয়। সেচও দেওয়া হয় গাছগুলোতে। এরপরও বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৩০০ তালগাছ নষ্ট হয়েছে। এভাবে যত্ন করে তিনি প্রায় ১ হাজার ৪০০ তালগাছ বড় করেছেন। তালগাছগুলোর বয়স এখন ১৫ বছর।

তালগাছ রক্ষা ও লোকজনের জন্য সামান্য কিছু করতে পেরে ভালো লাগে। একসময় আমি বেঁচে থাকব না। গাছগুলো থাকবে। লোকজন জানবে, একজন সাধারণ মানুষ এগুলো লাগিয়েছিলেন।
শহিদুল ইসলাম

মুরারীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুল মতিন বলেন, শহিদুলের এই গাছ লাগানো এলাকার লোকজন ভালোভাবে দেখছিলেন না। অনেকে তাঁর এই কাজকে পাগলামি বলেন।

কলেজশিক্ষক ফরিদ উদ্দিন বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে সন্তানের মতোই পরিচর্যা করে গাছগুলো বড় করেছেন শহিদুল।

শহিদুল ইসলামের স্ত্রী শরিফা বিবি স্বামীর এই কাজে খুশি। তিনি বলেন, ‘ওই সড়ক দিইয়্যা কোনটেও যাবার লাগলে তালগাছ দেইখ্যা বুক ভরে যায়।’ এসব গাছকে পরিবারের সদস্য বলে মনে হয় তাঁর।

গাছগুলো শহিদুলের সন্তানের মতো

বড় বিহানালী বাজারে শহিদুল ইসলামের দেখা পাওয়া গেল। আলাপে আলাপে জানালেন, ছোট চাকরি করে স্ত্রীসহ চার সদস্যের পরিবার চালাতে কষ্ট হয়। বেতন ও ছোট ব্যবসা করে কোনো রকমে সংসার চলান। অনেক শ্রম দিয়ে গাছগুলোকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। গাছের কোনো সমস্যা হলে তিনি উপজেলা প্রশাসনের কাছে যান। তাদের পরামর্শে গাছগুলোকে রক্ষা করতে পেরেছেন বলে জানান।

তালগাছের নিয়মিত পরিচর্যা করেন শহিদুল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

গাছগুলোকে সন্তান মনে করেন জানিয়ে শহিদুল বলেন, ‘তালগাছ রক্ষা ও লোকজনের জন্য সামান্য কিছু করতে পেরে ভালো লাগে। একসময় আমি বেঁচে থাকব না। গাছগুলো থাকবে। লোকজন জানবে, একজন সাধারণ মানুষ এগুলো লাগিয়েছিলেন।’

বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম বলেন, কিছুদিন আগে শহিদুল ইসলাম তাঁর কাছে এসেছিলেন। তালগাছ লাগানোর সপক্ষে বড় বিহানালী ইউপির চেয়ারম্যানের একটি প্রত্যয়নপত্র দেখান। পরে স্থানীয়ভাবে খোঁজখবর নিয়ে এর সত্যতা পান। তিনি শহিদুলের এমন কাজের প্রশংসা করে বলেন, তাঁর মতো অন্যদেরও এগিয়ে আসা উচিত।