পাঁচ বছর অস্ত্রোপচার বন্ধ

অস্ত্রোপচার কক্ষটি তালাবদ্ধ থাকায় অধিকাংশ মূল্যবান যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

পঞ্চগড়ের বোদা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অস্ত্রোপচার কক্ষটি পাঁচ বছর ধরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সেখানে এলোমেলোভাবে পড়ে আছে অস্ত্রোপচারের মূল্যবান যন্ত্রগুলো। গত সোমবার
ছবি: প্রথম আলো

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঁচ বছর ধরে কোনো অস্ত্রোপচার হচ্ছে না। শল্যচিকিৎসক আর অবেদনবিদের অভাবে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় প্রায় পাঁচ বছর ধরে অস্ত্রোপচার কক্ষটি (ওটি) তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সেখানে এলোমেলোভাবে পড়ে আছে অস্ত্রোপচারের মূল্যবান যন্ত্রগুলো। অস্ত্রোপচার কক্ষটি তালাবদ্ধ থাকায় অধিকাংশ মূল্যবান যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

শুধু তা–ই নয়, অপারেটর না থাকায় দীর্ঘ আট বছর ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে এক্স-রে যন্ত্রটি। সম্প্রতি সমস্যা দেখা দিয়েছে আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্রেও। এ ছাড়া শয্যাসংকট, পর্যাপ্ত চিকিৎসক আর প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এতে সেবা বঞ্চিত হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের। বিশেষ করে জরুরি রোগী ও দরিদ্র মানুষজন সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ছেন।

দেশের সর্বোত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলা ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এই উপজেলার জনসংখ্যা ২ লাখ ৭৫ হাজার ২৫২। উপজেলার মানুষের চিকিৎসাসেবার জন্য একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্থাপিত হয় ১৯৮১ সালে। শুরুতে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৩১ শয্যাবিশিষ্ট থাকলেও ২০০৮ সালে তা ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। তবে ২০১৪ সালে নতুন ভবন নির্মাণ করে পূর্ণাঙ্গভাবে ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হিসেবে চালু করা হয়। তখন থেকে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে জনবলসংকট লেগেই আছে। বোদা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের বাসিন্দারা ছাড়াও কাছাকাছি হওয়ায় জেলার আটোয়ারী উপজেলার বলরামপুর ইউনিয়ন ও ঠাকুরগাঁও জেলার দেবীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারাও এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসেন।

এখানে সার্জারি চিকিৎসক আর অবেদনবিদ না থাকায় অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে। শয্যাসংকটের কারণে রোগীদের চিকিৎসা দিতে কিছুটা অসুবিধা হয়।    
মো. লুৎফুল কবীর, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বোদা

জনবলকাঠামো অনুযায়ী এখানে ১০ জন বিশেষজ্ঞসহ ৩০ জন চিকিৎসক থাকার কথা। কিন্তু চিকিৎসকের পদায়ন হয়েছে ১৫ জনের। এর মধ্যে চারজন দীর্ঘদিন ধরে অজ্ঞাত কারণে অনুপস্থিত রয়েছেন। অনুপস্থিত চিকিৎসকদের মধ্যে একজন ২০১১ সাল থেকে এবং তিনজন ২০১৭ সাল থেকে অনুপস্থিত রয়েছেন। এ ছাড়া বাকি ১১ জনের মধ্যে ২ জন প্রেষণে অন্যত্র কর্মরত আছেন। বর্তমানে যে নয়জন চিকিৎসক কর্মরত আছেন, তাঁদের মধ্যে তিনজনই ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো থেকে সংযুক্ত করা। নার্স ৩৬ জনের মধ্যে ৩৫ জন আছেন। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর পদ ৮২টির মধ্যে ৩১টিই শূন্য। আর চতুর্থ শ্রেণির ২৫টি পদের মধ্যে ৭টিই শূন্য। এখানে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ, শিশু, মেডিসিন, সার্জারি, অর্থোপেডিক, চক্ষু, অ্যানেসথেসিয়াসহ ১০টি পদে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। এমনকি ডেন্টাল সার্জনও নেই।

১৭ জুলাই সরেজমিনে চিকিৎসক, নার্স ও রোগীদের সঙ্গে এই হাসপাতালের নানা সমস্যা নিয়ে কথা হয়। হাসপাতালের রেজিস্ট্রি খাতা থেকে দেখা যায়, এদিন সারা দিনে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৬৬ জন। আর রোগী ভর্তি ছিলেন ৬৮ জন।

চিকিৎসক ও নার্সরা জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির অস্ত্রোপচার কক্ষে ২০১২ কে ২০১৫ সাল পর্যন্ত নিয়মিত সিজারিয়ানসহ অন্যান্য অস্ত্রোপচার হতো। ২০১৬ সাল থেকে চিকিৎসকের অভাবে অস্ত্রোপচার বন্ধ হয়ে যায়। রেডিওগ্রাফারের অভাবে ২০১৫ সাল থেকে এক্স-রে যন্ত্রটি পড়ে থেকে বিকল হয়ে গেছে। আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র থাকলেও টেকনিশিয়ান নেই। জরুরি বিভাগে কর্মরত চিকিৎসকেই রোগীদের আলট্রাসনোগ্রাম করতেন। তবে এই যন্ত্রটিতেও সম্প্রতি সমস্যা দেখা দেওয়ায় এই সেবা বন্ধ রয়েছে। তবে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতি মাসে অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি স্বাভাবিক প্রসব করানো হয়।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি থাকা চন্দবাড়ি ইউনিয়নের বলরামহাট এলাকার রত্না রানী (৪৮) বলেন, তিনি শ্বাসকষ্ট নিয়ে তিন দিন আগে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু কোনো শয্যা পাননি। বাধ্য হয়ে তিন দিন ধরে মেঝেতে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

বৃদ্ধ মা সমিতা রানীকে নিয়ে সাকোয়া-বাকপুর থেকে হাসপাতালে আসা রমেশ চন্দ্র (৪০) নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘হাসপাতালে এত রোগী যে আমার মায়ের জন্য কোনো সিটের ব্যবস্থা করতে পারিনি। মেঝেতে রেখেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।’

বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. লুৎফুল কবীর বলেন, ‘আমি সম্প্রতি এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদান করেছি। এখানে যে চিকিৎসকেরা রয়েছেন, আমরা তাঁদের দিয়েই রোগীদের যথাযথ চিকিৎসাসেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এখানে সার্জারি চিকিৎসক আর অবেদনবিদ না থাকায় অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে। শূন্য পদের চিকিৎসকের চাহিদাপত্র যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া হয়েছে। তবে শয্যাসংকটের কারণে রোগীদের চিকিৎসা দিতে কিছুটা অসুবিধা হয়।’