১০ কচ্ছপের পেটে মিলল এক হাজারের বেশি ডিম, মার্চে ফুটবে বাচ্চা
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গত জানুয়ারি মাসে ডিম পাড়তে আসে বেশ কিছু সামুদ্রিক কচ্ছপ। এর মধ্যে ‘অলিভ রিডলে’ প্রজাতির ১০টি কচ্ছপ ডিম পেড়েছিল ১ হাজার ৯৩টি। কুকুর, গুইসাপ খেয়ে ফেলতে পারে, কিংবা চুরির শঙ্কায় ডিমগুলো সংগ্রহ করে পৃথক তিনটি প্রজনন হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করে বেসরকারি দুটি উন্নয়ন সংস্থা। আগামী মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটা শুরু হবে। তখন দুই-তিন দিন বয়সী বাচ্চাগুলো সমুদ্রে অবমুক্ত করা হবে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের প্যাঁচারদ্বীপ সৈকতের একটি হ্যাচারিতে গিয়ে দেখা গেছে, ঘরের আঙিনার বালুতে গর্ত খুঁড়ে কচ্ছপের ডিম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) নামের একটি বেসরকারি সংস্থা।
গত ৬ জানুয়ারি প্যাঁচারদ্বীপ সৈকতে ১২৫টি ডিম পাড়ে অলিভ রিডলে প্রজাতির একটি মা কচ্ছপ। ডিম পাড়ার পর ৬০ কেজি ওজনের কচ্ছপটি পুনরায় সমুদ্রে নেমে পড়ে। কচ্ছপের ডিমগুলো হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করেন নেকমের কর্মী আবদুল লতিফ। তিনি বলেন, এই হ্যাচারিতে বর্তমানে ৬২১টি ডিম রাখা হয়েছে। জানুয়ারি মাসে পাঁচটি কচ্ছপ ডিমগুলো পেড়েছিল। দ্রুত ডিমগুলো সংরক্ষণ না হলে কুকুর, গুঁইসাপ ও পাখিরা খেয়ে ফেলত। কিছু মানুষ সৈকতে ডিম চুরি করতে নামেন। সূর্যতাপের ওপর নির্ভর করে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার সময়কাল ৭০ থেকে ৯০ দিন।
নেকম কক্সবাজারের ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ূম বলেন, বর্তমানে প্যাঁচারদ্বীপ, সোনাদিয়া ও টেকনাফের শিলখালী সৈকতের তিনটি হ্যাচারিতে ১ হাজার ৯৩টি কচ্ছপের ডিম প্রজননের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্যাঁচারদ্বীপের নেকমের হ্যাচারিতে ৬২১টি, মহেশখালীর সোনাদিয়ার নেকমের আরেকটি হ্যাচারিতে ১৫০টি ও টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শিলখালী সৈকতে আরেকটি হ্যাচারিতে ৩২২টি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে।
শিলখালীর হ্যাচারিতে ডিমগুলো সংরক্ষণ করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোডেক। সেখানে তিনটি মা কচ্ছপ ৩২২টি ডিম পেড়েছিল। আগামী মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার সম্ভাবনা আছে।
তবে উন্নয়ন সংস্থার কর্মীরা বলছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার কচ্ছপের ডিম সংগ্রহ অনেকে কমেছে। কারণ, ডিম পাড়ার জন্য মা কচ্ছপ উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছে না। উপকূলজুড়ে পুঁতে রাখা নানা প্রজাতির নিষিদ্ধ জালে (বিহিঙ্গি ও কারেন্ট জাল) আটকা পড়েই অসংখ্য মা কচ্ছপ মারা যাচ্ছে।
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আনোয়ার হোসেন সরকার বলেন, কচ্ছপ সমুদ্রের ময়লা-আবর্জনা খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে; যা মাছের বংশবিস্তারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। অথচ মানুষের নিষ্ঠুর আচরণে কচ্ছপ এখন বিলুপ্তির পথে।
নেকমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে সৈকতের বালুচর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল ১০ থেকে ১২ হাজার ডিম। অন্তত ১ হাজার ৩০০ কচ্ছপ এই ডিম পেড়েছিল। ২০২২ সালে সৈকত থেকে নেকম ডিম সংগ্রহ করেছিল প্রায় এক হাজার। চলতি মৌসুমের গত দুই মাসে সংগ্রহ হয়েছে ১০টি কচ্ছপের ১ হাজার ৯৩টি ডিম। আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সৈকতে কচ্ছপের ডিম পাড়তে আসার কথা। একটি কচ্ছপ একসঙ্গে ৩০ থেকে ২৩০টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে।
সোনাদিয়া সৈকত থেকে টানা এক যুগ কচ্ছপের ডিম সংগ্রহ করে হ্যাচারিতে প্রজনন করে আসছেন স্থানীয় পরিবেশকর্মী গিয়াস উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বছর তিনেক আগেও ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে এই সৈকতে অন্তত ৫০০ কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসত। চলতি মৌসুমের দুই মাসে মাত্র দুটি কচ্ছপ ডিম পাড়তে এসেছিল। পুরো সৈকত এখন প্লাস্টিক বর্জ্য ও ময়লা–আবর্জনায় ভরপুর। লোকজনের কোলাহলও এখন অনেক বেড়ে গেছে।
ঝুঁকিতে সামুদ্রিক কচ্ছপ
গত বছরের ২২ ডিসেম্বর থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক থেকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার সৈকতে অন্তত ৩৭টি মরা মা কচ্ছপ ভেসে এসেছে বলে জানিয়েছে কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, উপকূলের ১০০ কিলোমিটারজুড়ে এক হাজার বিহিঙ্গি জাল ও কারেন্ট জাল বসানো থাকে। মাঝেমধ্যে কোস্টগার্ড কিছু জাল জব্দ করলেও পরে আবার নিষিদ্ধ জালগুলো বসানো হয়। সাগরে মাছ ধরার ট্রলারের জালে আটকা পড়েও বহু মা কচ্ছপের মৃত্যু হচ্ছে।
সম্প্রতি সৈকতের কবিতা চত্বর পয়েন্টে জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা একটি মরা কচ্ছপের মৃত্যুর কারণ নিয়ে অনুসন্ধান করে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দারের নেতৃত্বে একটি দল। সাঈদ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ওই কচ্ছপের গলা, বুক ও বাঁ পাশের পাখনায় জখমের দাগ পাওয়া গেছে। বালুচরে ডিম পেরে সমুদ্রে ফিরে যাওয়ার সময় নিষিদ্ধ বিহিঙ্গি জালে আটকা পড়ে কচ্ছপটির মৃত্যু হতে পারে। মূলত সমুদ্র উপকূলে পুঁতে রাখা মাছ ধরার জালে আটকা পড়েই অধিকাংশ মা কচ্ছপের মৃত্যু হচ্ছে।
মা কচ্ছপের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে মানসম্পন্ন গবেষণা করা দরকার বলে মনে করেন পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান বলেন, প্রায়ই জোয়ারের পানিতে মৃত কচ্ছপ ভেসে আসার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু জনবল-সংকটের কারণে কচ্ছপের ডিম পাড়ার স্থানগুলো সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। ২০১৭-১৮ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর হ্যাচারি স্থাপনের মাধ্যমে কচ্ছপের ডিম সংরক্ষণ ও প্রজননের মাধ্যমে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর কাজ করেছিল। এখন বেসরকারি কয়েকটি সংস্থা কাজটি পরিচালনা করছে।