চুন ও রং দিয়ে খেজুরের গুড় 

ভেজাল গুড় তুলনামূলক কম দামে বিক্রি করা হয়। না জেনে অনেকে কিনে খাচ্ছেন এসব গুড়। তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

মানিকগঞ্জে ভেজাল খেজুরের গুড়ে সয়লাব। এসব ভেজাল গুড় তৈরি ও বিক্রি বন্ধে বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালায় জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গতকাল সকালে হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

খেজুরের গুড় অথচ নেই খেজুরের রস। এ গুড়ের উপাদান ঝোলা গুড়, চিনি, চুন, রং ও সোডা। এসব ভেজাল গুড়ে সয়লাব মানিকগঞ্জের বিভিন্ন বাজার। এ ছাড়া এ জেলায় রাজশাহী ও নাটোর থেকেও ভেজাল খেজুরের গুড় আনা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শীত এলেই মানিকগঞ্জে এক শ্রেণির মৌসুমি ব্যবসায়ী ভেজাল খেজুরের গুড়ের ব্যবসায় নামেন। ভেজাল গুড় তুলনামূলক কম দামে বিক্রি করা হয়। না জেনে অনেকে কিনে খাচ্ছেন এসব গুড়। তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রায় সময় অভিযান চালালেও থেমে নেই ভেজাল গুড় তৈরি।

এসব ভেজাল গুড় খাওয়ার কারণে মানবদেহে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছেন মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মানবেন্দ্র সরকার। তিনি বলেন, এসব ভেজাল গুড় খাওয়ার ফলে গ্যাস্ট্রিক ও আলসার হতে পারে। এ ছাড়া লিভার ও কিডনির সমস্যা হতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত ভেজাল গুড় খাওয়ার ফলে মৃত্যুও ঘটতে পারে।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে সরেজমিন দেখা গেছে, হরিরামপুরের গোপীনাথপুর ইউনিয়নের উজানপাড়া গ্রামে বাড়িতে শেখ মাছেম আলী (৬০) রসের সঙ্গে চিনি ও চুন মিশিয়ে চুলায় জ্বাল দিচ্ছেন। বাড়ির সদস্যরা তাঁকে সহযোগিতা করছিলেন। মাছেম আলী প্রথম আলোকে বলেন, ছয় কেজি রসের সঙ্গে পাঁচ কেজি চিনি দিয়ে খেজুরের গুড় তৈরি করছেন। এতে আট কেজির মতো গুড় হবে। এসব খেজুরের গুড় হিসেবে বিক্রি করা হবে। প্রতি কেজি গুড় ১৫০ টাকা কেজি দরে পাইকারি বিক্রি করে থাকেন মাছেম।

খবর পেয়ে গতকাল ভেজাল গুড় তৈরির অপরাধে মাছেম আলীকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করেন জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান রুমেল। সেই সঙ্গে তাঁকে ভেজাল গুড় তৈরি না করার নির্দেশ দেন তিনি। আসাদুজ্জামান রুমেল বলেন, ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরি ও বিক্রি বন্ধে হরিরামপুর এবং শিবালয় উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গাছিবাড়ি ও বাজারগুলোয় অভিযান চালানো হচ্ছে। জরিমানার পাশাপাশি ভেজাল গুড় ধ্বংস করা হচ্ছে। এরপরও ভেজাল গুড় তৈরি ও বিক্রি করা হলে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এসব ভেজাল গুড় খাওয়ার ফলে গ্যাস্ট্রিক ও আলসার হতে পারে। এ ছাড়া লিভার ও কিডনির সমস্যা হতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত ভেজাল গুড় খাওয়ার ফলে মৃত্যুও ঘটতে পারে। 
মানবেন্দ্র সরকার, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল 

পাশের মজমপাড়া গ্রামে আসলাম হোসেনের (৫০) বাড়িতে গিয়েও ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরি করতে দেখা যায়। ঝোলা গুড়, চিনি ও চুন মিশিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করছিলেন আসলাম। তিনি বলেন, ‘এগুলোতে খারাপ কিছু দেওয়া হয় না। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরেই তো আমাগো এলাকায় অনেকে এসব গুড় বানিয়ে জেলার বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করে আসছে।’

স্থানীয় লোকজন জানান, হরিরামপুর উপজেলার গোপীনাথপুর ও বাল্লা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরি হচ্ছে। খেজুরের রস ছাড়াই ঝোলা গুড়, চুন, রং ও চিনি দিয়ে এসব গুড় বানানো হচ্ছে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এসব গুড় কম দামে বিক্রি হওয়ায় গরিব মানুষ এগুলো কিনে খাচ্ছেন। এ ছাড়া পাশে শিবালয় উপজেলাতেও মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরি করে আসছেন।

হরিরামপুরের ঝিটকা বাজার খেজুর গুড়ের অন্যতম বড় মোকাম। গতকাল সকালে ওই বাজারে গিয়ে কম মূল্যের এসব ভেজাল খেজুরের গুড়ের পসরা সাজিয়ে ব্যবসায়ীদের বসে থাকতে দেখা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, পাশের গোপীনাথপুর শিকদার পাড়া গ্রামের এক ব্যক্তি নিজ বাড়িতে এসব গুড় তৈরি করেন। তাঁর কাছ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে গুড় কিনে এনে ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে থাকেন।

কেন ভেজাল গুড় বিক্রি করছেন জানতে চাইলে ওই ব্যবসায়ী বলেন, এখন আগের মতো খেজুর গাছ নেই। আশপাশের এলাকায় যেসব গাছে খেজুরের রস সংগ্রহ হয়ে থাকে তার অধিকাংশ দিয়ে হাজারি গুড় তৈরি হয়ে থাকে। রসের স্বল্পতার কারণে এবং চাহিদা বেশি থাকায় রসের সঙ্গে চিনি ও চুন দিয়ে এসব গুড় তৈরি করা হয়ে থাকে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ক্যাব) মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি গোলাম ছারোয়ার বলেন, স্বাস্থ্যকর খাবার মানুষের অধিকার। ঝোলা গুড়ের সঙ্গে চিনি, চুন, সোডা মিশিয়ে ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরি হচ্ছে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরি ও বিক্রি বন্ধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নজরদারি বাড়াতে হবে।