উপকূলে জীবনের লড়াই ক্রমেই কঠিন হচ্ছে

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতের পর থেকে চার বছর ধরে কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধের ওপর ঝুপড়িতে বাস করছেন খুলনার কয়রার কাটমারচর গ্রামের সাইফুল্লাহ ঢালীর পরিবার
ছবি: প্রথম আলো

২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ ধসে লবণ পানি প্রবেশ করেছিল গ্রামে। লবণ পানির নিচে ডুবে গিয়েছিল গ্রামের পর গ্রাম। সেই থেকে গ্রামের সবুজ হারিয়ে গেছে। লবণাক্ততায় গ্রামে ধান চাষ করা সম্ভব ছিল না। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে ধানের জমিতে চিংড়ি চাষ শুরু করে। আম্পান এলাকার দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে।

কথাগুলো বলছিলেন খুলনার সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় উপজেলা কয়রার কাটমারচর গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেম। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবের চার বছর আজ সোমবার। ২০২০ সালের এই দিনে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আঘাত হানে আম্পান। এতে কয়রার চারটি ইউনিয়ন বিধ্বস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে মানুষের ঘরবাড়ি, কৃষিজমি, চিংড়ির খামার, পুকুর, ডোবা—সবকিছু তলিয়ে যায়। চার বছর পরও এই অঞ্চলের মানুষ আম্পানের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। সে কথাই বলছিলেন আবুল কাশেম।

গতকাল রোববার কয়রার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কৃষক আবুল কাশেমের কথাগুলোর সঙ্গে মাঠের দৃশ্যপটের হুবহু মিল দেখা যায়। লবণাক্ততার কারণে অনেক মাঠে এখন আর সবুজ নেই। অনেক এলাকার জমি ও চিংড়ির ঘের এখনো চাষের উপযোগী হয়নি। আম্পানে বাড়িঘর হারানো অনেকে বেড়িবাঁধের ওপর ঝুপড়ি তুলে বসবাস করছেন। কৃষক বা চিংড়ির ঘেরের মালিকদের অনেকে এখন দিনমজুর। কেউ কেউ সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া ধরে সংসার চালাচ্ছেন। অনেকে এলাকা ছেড়ে শহরে পাড়ি দিয়েছেন।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আম্পানে কয়রার উত্তর ও দক্ষিণ বেদকাশী এবং কয়রা সদর ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষতি হয়। আংশিক ক্ষতি হয় মহারাজপুর ইউনিয়নে। এতে উপজেলার দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছিলেন। আংশিক ও সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা ছিল ৩৮ হাজার। এ ছাড়া ৩ হাজার হেক্টর ফসলি ও ৪ হাজার হেক্টর জমির মাছের ঘের লোনাপানিতে তলিয়ে গিয়েছিল।

গতকাল দিনভর কয়রার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কাটমারচর, হাজতখালী, গাতিরঘেরী, হরিণখোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় আম্পানের সময় কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর বাঁধ ভেঙে স্রোতের তোড়ে তৈরি হওয়া খালগুলোতে এখনো পানি থই থই করছে। বহু মানুষ এখনো আছেন বেড়িবাঁধের ওপর ঝুপড়িতে।

কপোতাক্ষপাড়ের কাটমারচর গ্রামের বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে কথা হয় সাইফুল্লাহ ঢালীর সঙ্গে। বড় ঝড় আসছে, জোয়ারের পানি বাড়ছে দ্রুতগতিতে। এসব জেনেও সেদিন স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বাড়িতেই ছিলেন তিনি। মধ্যরাতে হঠাৎ পানির শব্দে ঘরের বাইরে এসে টর্চলাইটের আলোয় দেখেন বিকট শব্দে নদের বাঁধ ভেঙে পানির স্রোত আসছে বাড়ির দিকে। পড়িমরি করে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বাড়ির কাছে একটি একতলা স্কুল ভবনে গিয়ে আশ্রয় নেন। অল্প সময়ে সেই ভবনের নিচতলা পানিতে ডুবে যায়। অবশেষে সাইফুল্লাহ ঢালী এবং তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা কপোতাক্ষ নদীর তীরে বেড়িবাঁধের ওপর আশ্রয় নেন। সেই রাত থেকে এখন পর্যন্ত তাঁরা সেখানেই বাস করছেন।

সাইফুল্লাহ ঢালী বলেন, ‘আম্পানের আগে দিনমজুরি করতাম, যা উপার্জন হতো, তাতে ভালোই চলত সংসার। কিন্তু আম্পান আমার সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এখন কিছুই নাই। ঝড়ের রাতে ঘাড়ে আঘাত পেয়েছিলাম। সেই থেকে শক্ত কাজ করতে পারি না। এখন নদীতে মাছ ধরে কোনোমতে সংসার চালাই।’

হাজতখালী গ্রামে গিয়ে কথা হয় পরিমল মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি বলেন, একসময় তাঁদের সবই ছিল। আম্পানের রাতে কপোতাক্ষ নদের বাঁধ ভেঙে সব শেষ হয়ে যায়। চার বিঘা জমির ভিটাবাড়ির মাত্র ৩ শতাংশ আছে। বাকিটা আম্পানের প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে গোটা গ্রাম পানিতে ভেসে যায় সেদিন। হাজতখালী, কাটমারচর, উত্তর বেদকাশী এবং অন্যান্য গ্রামের বহু পরিবারের ঠাঁই হয় বেড়িবাঁধে। টানা ছয় মাস ধরে ঠিকমতো কেউ রান্না, খাওয়াদাওয়া করতে পারেনি। পরে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী অনেক পরিবার নতুন করে ঘরবাড়ি তৈরি করে বাড়ি ফিরেছে, অনেকে অন্যত্র চলে গেছে, তবে উপায় না থাকায় এখনো অনেকেই রয়ে গেছে বাঁধের ওপর।

উপজেলার কাশির হাটখোলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, হাটের সারি সারি খুপরি দোকানগুলোতে পরিবার নিয়ে বাস করছে চার বছর আগে আম্পানে গৃহহারা কয়েকটি পরিবার। সেখানে কথা হয়, ‘ফুলবাসি সরদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে জমি, বসতভিটা সবই ছিল আমাদের। এখন আমরা হাটখোলার খুপরি ঘরের বাসিন্দা।’

খাশিরহাটখোলা এলাকার নিলকান্ত সরদার জানান, আম্পানে ভেঙে যাওয়া কয়রা-কাশিরহাট সড়কটি চার বছরেও সংস্কার হয়নি। এখানে নেই চিকিৎসার সুব্যবস্থা। অনেক জায়গায় সুপেয় পানির সংকট তীব্র। এলাকার বেড়িবাঁধগুলোর অবস্থাও নাজুক। সরকারের কাছে পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও টেকসই বেঁড়িবাধ নির্মাণের দাবি এলাকাবাসীর।

কয়রা সদর ইউনিয়নের গোবরা গ্রামের বয়োবৃদ্ধ আত্তাপ আলী শেখ বলছিলেন, কেবল আম্পানই যে তাঁদের নিঃস্ব করেছে তা নয়। আম্পানের পর কয়েকটি বড় দুর্যোগ মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হয়েছে তাঁদের। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এলাকা। এসব দুর্যোগ নতুন দুর্ভোগের মুখোমুখি করেছে মানুষকে।

কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম বাহারুল ইসলাম বলেন, আম্পানের ক্ষত এখনো শুকায়নি। একের পর এক দুর্যোগের হানায় অসহায় মানুষেরা যে যেভাবে পারছে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। এলাকায় লবণাক্ততা ও কাজের অভাবে মানুষ বাইরে চলে যাচ্ছে। আম্পানের পর ভেঙে যাওয়া নদীর বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হলেও কয়েকটি স্থানের বেঁড়িবাধ এখনো রয়েছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। স্থায়ী টেকসই বেড়িবাঁধের দাবি এলাকাবাসীর।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তারিক উজ জামান বলেন, উপজেলাটি তিন দিক থেকে নদীবেষ্টিত। যে কারণে ছোটখাটো দুর্যোগেও প্লাবিত হয়ে পড়ে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ে। দুর্যোগে এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে পুনর্বাসনে সরকারের পাশপাশি বেসরকারি কয়েকটি সংগঠন তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বেড়িবাঁধে বসবাসকারী লোকজনকেও পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে।