ভোরের আলো ফোটার পরপরই বিভিন্ন এলাকা থেকে আসতে থাকেন ক্রেতা ও বিক্রেতারা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমজমাট হয়ে ওঠে বাজার। সকাল ছয়টা থেকে আটটা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা চলে কেনাবেচা। এই সময়ে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয়।
মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভার পেছনে (লঞ্চঘাট সড়কের পূর্বপাশে) এ বাজারের অবস্থান। এটিকে স্থানীয়ভাবে রিকাবীবাজার মাছঘাট বলা হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ১০০ থেকে ১২৫ বছর আগে ৫-৭টি দোকান নিয়ে শুরু হয়েছিল এ বাজারের যাত্রা। এরপর আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। বাড়তে থাকে আড়তের সংখ্যা। বর্তমানে ৪০টি আড়ত রয়েছে। এখানে পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী নদীর তাজা মাছ নিয়ে আসেন জেলেরা।
এ ছাড়া বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, রাঙামাটি, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসে ইলিশ, চিংড়ি, পোয়া, পাঙাশ, বেলে, বাইমসহ দেশি, বিদেশি ও সামুদ্রিক মাছ। ভারত ও মিয়ানমার থেকেও আসে মাছ। ব্যবসায়ীরা এসব মাছ পাইকারি দামে কিনে মুন্সিগঞ্জের শহর, গ্রামের বাজার ও পাড়া-মহল্লায় বিক্রি করেন। এ ছাড়া প্রতিদিন মাছ যায় টঙ্গিবাড়ী ও সিরাজদিখান উপজেলায়।
আড়তদার ছাড়াও অন্তত ৮০-১০০ জন খুচরা বিক্রেতা প্রতিদিন এ বাজারে মাছ বিক্রি করেন। পাইকারি ও খুচরা মাছ কিনতে আসেন দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ।
বৃহস্পতিবার সকালে এ মাছঘাটে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন আড়তদারেরা। খুচরা-পাইকারি ক্রেতা–বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগরম বাজার। কেউ বাড়ির জন্য মাছ কিনছেন। কেউবা বিক্রির জন্য। অনেকে মাছ কিনে ঝামেলা এড়াতে আবার সেগুলো বাজারেই কাটিয়ে নিচ্ছেন।
স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারটি জমে ওঠায় স্থানীয় অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বাজারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় অনেকে পাইকারি ও খুচরা মাছের ব্যবসা করছেন। অনেকে মাছ কাটার কাজ করেন। মাছের জন্য ব্যাগ, পলিথিন, বরফ বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে কাঁচা সবজি ও খাবারের ব্যবসাও গড়ে উঠেছে এ বাজারকে কেন্দ্র করে।
সিরাজুল ইসলাম নামের এক এনজিও কর্মী বলেন, তাঁর বাড়ি টঙ্গিবাড়ী উপজেলার আবদুল্লাহপুরে। পাঁচ বছর ধরে প্রতি মাসের মাছের বাজার করেন এখান থেকে। এ বাজারের মাছের দাম অন্যান্য বাজারের তুলনায় কম। সেই সঙ্গে সব ধরনের তাজা মাছ পাওয়া যায়।
শহরের খাল ইস্ট এলাকার মরিয়ম বেগম প্রথম আলোকে বলেন, শহরের বাজারে এখান থেকে নিয়ে মাছ বিক্রি করা হয়। তাই সেখানে দাম বেশি। তাঁর মাছের প্রয়োজন হলে এখানে আসেন। তাজা মাছ কিনে বাড়ি ফেরেন।
রিকাবীবাজার মাছঘাটে ৪০ বছর ধরে আড়তদারি করেন শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, তাঁদের আড়তে সব ধরনের মাছ পাওয়া যায়। তুলনামূলক দাম কম হওয়ায় মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারেরা এ বাজারে মাছ নিতে আসেন।
টঙ্গিবাড়ী উপজেলার পাঁচগাঁও বাজারে মাছের ব্যবসা করেন ফারুক আলম।রিকাবীবাজার মাছঘাট থেকে প্রতিদিন সকালে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার মাছ কেনেন তিনি। ফারুক আলমের ভাষ্য, এখানে সব ধরনের মাছ পাওয়া যায়। মাছের দামও কম। তাই এখান থেকে মাছ কিনে নিয়ে তিনি পাঁচগাঁও বাজারে বিক্রি করেন।
তবে আড়তদার, ক্রেতা ও বিক্রেতাদের অভিযোগ, খোলা আকাশের নিচে ও মাটির মেঝেতে বসে বেচাকেনা করতে হয় তাঁদের। বৃষ্টি এলে বিক্রি কমে যায়। কাদাপানিতে হাটের অবস্থাও শোচনীয় হয়ে ওঠে তখন।
২৪ বছর ধরে রিকাবীবাজার ঘাটে মাছের ব্যবসা করেন আড়তদার মামুন সিদ্দিকী টুটুল। তিনি বলেন, তাঁর বাবা–দাদাও এ বাজারে মাছের ব্যবসা করতেন। শত বছরের পুরোনো এ মাছের হাট থেকে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে মানুষ মাছ কিনতে আসেন। বেচাকেনাও ভালো হয়। তবে বৃষ্টির মৌসুমে খোলা আকাশের নিচে ভোগান্তি হয় তাঁদের।
রিকাবীবাজার মাছঘাট সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে বাজারে অন্তত ৪০ জন আড়তদার আছেন। তাঁদের মধ্যে ৩৬ জন সমিতির আওতাভুক্ত। এ বাজারে প্রতিদিন সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয়। তবে ইলিশ মৌসুমে বিক্রি আরও বাড়ে।
মাছের এ বাজারটিকে ঐতিহ্যবাহী উল্লেখ করে মুন্সিগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শামসুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় লোকজন এটি গড়ে তুলেছেন। তাঁরা চাইলে মাথার ওপরে শেড ও ময়লা পানি সরানোর ব্যবস্থা করা হবে।