ইন্টারনেট ও মাদক ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব, বাড়িতে ঢুকে যুবককে কুপিয়ে হত্যা
নরসিংদী শহরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে এক যুবককে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রোববার রাত ১০টার দিকে শহরের বানিয়াছল এলাকার একটি নির্জন বাড়িতে ঢুকে তাঁকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।
স্বজন ও স্থানীয় লোকজনের দাবি, ইন্টারনেট ব্যবসা পরিচালনা ও মাদক ব্যবসার দ্বন্দ্বের জেরেই এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন কাউসার মিয়া নামের এক যুবক। তিনি বর্তমানে এলাকায় ইন্টারনেট ও মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন।
নিহত যুবকের নাম মো. আল আমিন ওরফে হাতকাটা আলামিন ওরফে চান্দু আলামিন (৩২)। তিনি বানিয়াছল এলাকার মৃত ইব্রাহীম মিয়ার ছেলে। বছর চারেক আগে একদল সন্ত্রাসীর ধারালো অস্ত্রের কোপে তাঁর দুই হাতের কবজি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর পর থেকে তিনি হাতকাটা আলামিন নামে পরিচিত।
নিহত আল আমিনের স্ত্রী তানিয়া আক্তার বলেন, ‘কাউসার জোর কইরা আমার স্বামীর ইন্টারনেট ব্যবসা কাইরা নিছিল। পরে মারামারি হইলে তার ভয়ে সাত মাস পালাইয়া থাকতে হইছে তারে (আল আমিনকে)। কাউসার অনেকবারই আমগরে হুমকি দিছে, এলাকায় ঢুকলে তারে (আল আমিনকে) একেবারে মাইরা ফেলব। গতকাল এলাকায় ঢুকছে, সত্যি সত্যিই কুপাইয়া তারে (আল আমিনকে) মাইরা ফেলছে। আমার চার বছরের ছেলেকে যারা এতিম করছে, তাদের সবার ফাঁসি চাই।’
স্বজন, পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মো. আল আমিন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারনেট ও মাদকের ব্যবসা করছেন। সাত মাস আগে ক্ষমতা দেখিয়ে তাঁর ইন্টারনেট ব্যবসা ছিনিয়ে নেন এলাকার অপর মাদক ব্যবসায়ী কাউসার মিয়া। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হলে কাউসার মিয়ার কয়েকজন সহযোগী ধারালো অস্ত্রের কোপে আহত হন। এ ঘটনায় মামলা হলে মো. আল আমিন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। সাত মাস পালিয়ে থাকার পর গতকাল রাতে এলাকায় ফিরেছিলেন তিনি। তাঁকে এলাকায় একা পেয়ে কাউসার মিয়ার নেতৃত্বে অন্তত ২০ জন ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাঁর পিছু নেন। রাত ১০টার দিকে মো. আল আমিন দৌড়ে একটি নির্জন বাড়িতে ঢুকে পড়লে তাঁরাও সেখানে যান। এ সময় তাঁর মাথায়, পিঠে, পেটে ও পায়ে উপর্যুপরি কোপান তাঁরা। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর লাশ সেখানে ফেলে রেখে চলে যান। পরে স্থানীয় দুজন ব্যক্তি তাঁর লাশ ১০০ শয্যাবিশিষ্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেন।
গতকাল রাত ১২টার দিকে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মো. আল আমিনের স্ত্রী তানিয়া আক্তার, মা রোকেয়া বেগম, বড়ভাই মো. রহিম মিয়া, দুই বোন ফাতেমা আক্তার ও হাজেরা আক্তারসহ পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা হাসপাতাল চত্বরে আহাজারি করছেন। মা রোকেয়া বেগম বারবার ছেলের লাশ দেখতে চাচ্ছিলেন আর ‘আমার ছেলেকে ফিরাইয়া দেও’ বলতে বলতে কান্নায় মূর্চ্ছে পড়ছিলেন। নিহত আল আমিনের বন্ধু, স্বজনসহ শতাধিক লোকজনকে লাশ দেখতে হাসপাতালে অপেক্ষা করছিলেন।
পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, হামলার ভয়ে সাত মাস বাড়ির বাইরে ছিলেন আল আমিন। চার দিন আগে তাঁর শ্বশুরের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে শুনে জেলা হাসপাতালে আসেন তিনি। পরে তিন দিন ঢাকার একটি হাসপাতালে শ্বশুরের সঙ্গেই ছিলেন। গতকাল রাতে কাউকে কিছু না জানিয়ে আল আমিন এলাকায় চলে আসেন। তাঁকে দেখতে পেয়ে কাউসার তাঁর দলবল নিয়ে আল আমিনের পেছনে ছোটেন। পরে আল আমিন বানিয়াছল এলাকার একটি নির্জন বাড়িতে ঢুকে পড়লে সেখানেই তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার পর কাউসারই তাঁদের বাড়িতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানান। এরপরই তাঁরা হাসপাতালে ছুটে এসে আল আমিনের রক্তাক্ত লাশ দেখতে পান।
ঘটনার পর থেকে কাউসার ও তাঁর সহযোগীরা পলাতক রয়েছেন। ফলে এ বিষয়ে তাঁদের কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
১০০ শয্যাবিশিষ্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এ এন এম মিজানুর রহমান বলেন, ‘আল আমিন নামের ওই যুবককে রাত ১১টা ৩ মিনিটে মৃত অবস্থায় আমাদের হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তাঁর মাথার পেছনের অংশে ধারালো অস্ত্রের কোপে ব্রেইন ম্যাটেরিয়াল বের হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া তার পিঠের আটটি স্থানে, বুক ও পেটের ডান পাশের দুই জায়গায় এবং একটি পায়ে মোট ১১টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তাঁর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মো. আল আমিন ওরফে হাতকাটা আলামিন ওরফে চান্দু আলামিনকে ব্যক্তিগত বিরোধে প্রতিপক্ষ হত্যা করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে মাদক, দ্রুত বিচার, সরকারি কাজে বাধাসহ মোট ৮টি মামলা আছে। যাঁরা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের প্রত্যেককে এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে।