পোলট্রি খামারে সচ্ছল এক গ্রামের শত পরিবার

নিজের খামারে মুরগির পরিচর্যা করছেন খামারি কৃষ্ণ কুমার দাশ। ৬ মে সকালে মিরসরাইয়ের চরশরৎ গ্রামে।প্রথম আলো

তিন বছর আগেও দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন লিংকন দাশ (৩৭)। মা–বাবা, স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে দারিদ্র্যের সে সময়টা ছিল বড় কষ্টের। এলাকায় মুরগির খামার করে স্বপ্নের মতো বদলে গেছে লিংকনের দিন। খামার শুরুর তিন বছরের মধ্যেই অভাব ঘুচেছে তাঁর। বাড়িতে তুলেছেন নতুন ঘর। মুরগি বিক্রির লাভের টাকায় কিনেছেন চারটি গরু। একসময়ের দিনমজুর লিংকনের দুটি খামারে কাজ করেন দুই কর্মচারী। খামার করে সচ্ছল লিংকন এখন মাসে আয় করেন লাখ টাকা। সাফল্যের এই গল্প কেবল লিংকনের নয়; মুরগির খামার করে মিরসরাইয়ের ইছাখালী ইউনিয়নের চরশরৎ গ্রামের শত পরিবারের দিন বদল হয়েছে।

৬ মে সকালে চরশরৎ গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি বাড়ির আশপাশে আছে মুরগির খামার। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাড়ির পাশ ছাড়িয়ে কিছু দূরে রাস্তার পাশের কৃষিজমিতে গড়ে তোলা হয়েছে অনেক খামার। দূর থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল টিনের চালা দেওয়া খামারগুলোতে চলছে মুরগি উৎপাদনের কর্মযজ্ঞ। মুরগির পরিচর্যায় ব্যস্ত মালিক ও কর্মচারীরা।

স্থানীয় লোকজন, খামারের মালিক ও জনপ্রতিনিধিরা জানান, মিরসরাই উপজেলার পশ্চিমে সমুদ্র উপকূলঘেঁষা চরশরৎ গ্রাম ছিল খুবই অনগ্রসর এলাকা। চরাঞ্চলে জমি বর্গা চাষ করাই ছিল প্রায় ৩০০ পরিবারের গ্রামটির অধিকাংশ মানুষের পেশা। বর্গা জমি চাষ করে পেটেভাতে চলা গেলেও সংসারে সচ্ছলতা ছিল না মানুষের।

এমন দীনহীন জীবনের বৃত্ত ভেঙে বের হতে ২০০৪ সালে প্রথম ১ হাজার ৬০০ ব্রয়লার মুরগির একটি খামার গড়েন গ্রামের বাসিন্দা সীতানাথ দাশ। খামার করে তিনি সফল হলে তাঁর দেখাদেখি গত ২০ বছরে চরশরৎ গ্রামে গড়ে উঠেছে ছোট–বড় ১২০টি মুরগির খামার। এখন এসব খামারে পালন করা হয় আড়াই লাখের বেশি ব্রয়লার মুরগি। প্রতি মাসে এ গ্রামে এখন উৎপাদিত হয় ২৫০ টন মুরগির মাংস। এসব মাংসের বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা। চরশরৎ গ্রামের মুরগির খামারিদের সবাই দেশের বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক মুরগি পালন করেন।

পাঁচ বছর আগে ২ হাজার ৩০০ মুরগি দিয়ে শুরু করে এখন ১০ হাজার মুরগির খামারের মালিক চরশরৎ গ্রামের কৃষ্ণ কুমার দাশ। নিজে আগে তেমন কিছু না করলেও এখন ছয়জন কর্মচারী চালান তিনি। জানতে চাইলে এ খামারি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুরগির খামার আমাদের গ্রামের মানুষের জন্য আশীর্বাদ। আগে যারা দিনমজুরি করত, তাদের অনেকেই এখন খামার করে সচ্ছলতার মুখ দেখেছে। খামারের আয়ে বাড়িঘর করছে, জমিজিরাত কিনছে। মালিক–শ্রমিকসহ গ্রামের অন্তত ৪০০ মানুষ সরাসরি এসব মুরগির খামারের সঙ্গে জড়িত। লাভজনক হওয়ায় গ্রামে প্রতিনিয়ত বাড়ছে খামারের সংখ্যা।’

খামারের আয় দিয়ে মোটরসাইকেল কিনেছেন এক সময় দিন মজুরি করা লিংকন দাশ। ৬ মে সকালে মিরসরাইয়ের চরশরৎ গ্রামে
প্রথম আলো

এই খামারি আরও বলেন, ‘খামার করতে গিয়ে একটি স্থায়ী বর্জ্যাগার ও একটি রোগ নির্ণয় ল্যাবের অভাবে ভুগছি আমরা। এখন মুরগির কোনো রোগ হলে ফেনী শহরে নিয়ে রোগ নির্ণয় করে আনতে হয়। এতে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় খামারির অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। আর এখানে স্থায়ী কোনো বর্জ্যাগার না থাকায় যত্রতত্র মুরগির লিটার ফেলায় পানিসহ পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এ দুটি বিষয়ে আমরা সরকারের সহযোগিতা চাই।’

জানতে চাইলে ইছাখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল মোস্তফা বলেন, ‘চরশরৎ গ্রামের মানুষ ব্রয়লার মুরগি পালনে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। একসময় গ্রামটির মানুষ খুব দরিদ্র ছিল। এখন মুরগির খামার গ্রামের অনেক মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। তবে মুরগির লিটার থেকে তৈরি হওয়া বর্জ্যের ভালো ব্যবস্থাপনা না থাকায় এখানে বড় একটি পরিবেশগত সংকটও তৈরি হচ্ছে।’

চরশরৎ গ্রামে পোলট্রিশিল্পের এমন প্রসারের বিষয়ে জানতে চাইলে মিরসরাই উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জাকিরুল ফরিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিরসরাইয়ের ইছাখালী ইউনিয়নের চরশরৎ গ্রামে শতাধিক পোলট্রি খামার আছে। এক গ্রামে এতগুলো খামার এ অঞ্চলে বেশ বিরল। এসব খামার এলাকার লোকজনের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশের আমিষের চাহিদা পূরণে বড় একটি ভূমিকা রাখছে। এসব খামারির সমস্যা সংকটে আমরা সব সময় পাশে থাকি। মিরসরাই উপজেলা পোলট্রিশিল্পে সমৃদ্ধ এলাকা। খামারিদের দাবি সমর্থন করে আমিও বলব, এখানে একটি পোলট্রি রোগ নির্ণয় ল্যাব হওয়া খুব জরুরি।’