সাগরে স্বজন হারানোদের দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে

গত বছর বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে মারা যাওয়া মহিদুল মোল্লার মা হাসিনা বেগম ও স্ত্রী মুর্শিদা বেগমছবি: প্রথম আলো

বলেশ্বর নদের ছোট শাখা খালটি স্থানীয় লোকজনের কাছে পরিচিত বগার খাল নামে। খালের এক পাশের গ্রামের নাম ‘বগা’ অন্য পাশের গ্রাম ‘ভাষা’। এই দুই গ্রামের অধিকাংশ মানুষেরই পেশা মাছ শিকার। বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার এই গ্রাম দুটির জেলেদের বেশির ভাগই মাছ ধরেন বঙ্গোপসাগরে। সাগরের ঢেউয়ের মতোই দোদুল্যমান তাঁদের জীবন। যেখানে প্রতিমুহূর্তে চলে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।

গত এক দশকে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে বিভিন্ন দুর্যোগে গ্রাম দুটির অর্ধশত জেলে নিখোঁজ হয়েছেন বা মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁদের অনেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাই পরিবারগুলো হয়ে পড়েছে অসহায়, কাটাচ্ছে মানবেতর জীবন।

তেমনই এক পরিবারের বড় ছেলে তরিকুল ইসলাম (১৫)। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় তরিকুলের বাবা মহিদুল মোল্লা সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে মারা যান ২০২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। সে রাতে ঝড়ের কবলে পড়ে সুন্দরবনের দুবলার চরসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ডুবে গিয়েছিল বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনাসহ উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকার অন্তত ২৯টি ট্রলার। তারই একটি ট্রলারের জেলে ছিলেন মহিদুল মোল্লা।

মহিদুলের স্ত্রী মুর্শিদা বেগম বলেন, ‘তিনটা ছেলে রাইখে স্বামীডা চইলে গেল। বড় ছেলেরে ১৭ পারার হাফেজ বানিয়েছিলাম। মনে অনেক আশা ছিল। কিন্তু ওর আব্বু মারা যাওয়ার পর ওকে কাজে পাঠাইতে হইছে।’

ছোট দুই ছেলে আরিফুল (১৩) ও আবির (৯) স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের সপ্তম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। মুর্শিদা বলেন, ‘খুব কষ্টে আছি। কখনো দিনে দুই বেলা খেয়েও কাটে, না খেয়েও কাটে। বাচ্চাদের পরীক্ষার ফিও দিতে পারি নাই। যেভাবে সবকিছুর দাম বাড়ছে সামনে কীভাবে চলব, তা জানি না। মাথায় কোনো কাজ করে না। সব ওপরওয়ালার ওপরে ছেড়ে দিয়েছি। আল্লাহ বাচাইলে বাঁচব, না বাঁচাইলে; আল্লাহ যেমন একজনরে নিছে, সেইভাবে যেন আমাদেরও নিয়া যায়।’

ঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলারডুবির দুই দিন পর পাওয়া গিয়েছিল মহিদুলের লাশ। সেই স্মৃতি মনে করে আহাজারি করতে করতে মহিদুলের মা হাসিনা বেগম বলেন, ‘আমার এট্টামাত্র ছেলে। যাওয়ার সময় বইলে গেছে যে মা পয়সাকড়ি থুইয়ে যাইতে পারলাম না, যা আছে তাই অল্প অল্প করে খাইয়ো, আর আল্লাহ আল্লাহ কইরো। আমি কয়েক দিনের মধ্যে আসতেছি। কিন্তু কী হইল? সব অন্ধকার। আমি আমার ছেলের মুখ খানও দেখতে পারলাম না।’

সেই রাতে সাগরে ঝড়ে কবলে ডুবে যাওয়া ট্রলারগুলোর অনেক জেলেকে উদ্ধার করা হয় এক থেকে দুই দিন পর। মারা যান অন্তত সাতজন। তাঁদের একজন মহিদুল।

একই গ্রামের নূরনাহার বেগমের স্বামীও মারা গিয়েছিলেন সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে। ২০১৫ সালের নভেম্বরের এক ঝড়ে নিখোঁজ হন ওলিয়ার মোল্লা। দুই সন্তানকে নিয়ে এখন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে নূরনাহারের। গত সোমবার সকালে জেলে গ্রামের তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মাছ ধরার জাল ঠিক করছেন তিনি। কথায় কথায় জানান, সাত বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর ঘোর অমানিশা নেমে আসে তাঁর জীবনে। আট বছর ও দুই মাস বয়সী ছেলেদের নিয়ে অভাবের সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকেন।

ঘরের বারান্দায় বসে জাল তৈরি করছেন বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে মারা যাওয়া মো. তালেবের স্ত্রী মরিয়ম বেগম
ছবি: প্রথম আলো

বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামের মাঝেও খেয়ে না খেয়ে সন্তানদের লেখাপড়া করাচ্ছেন নূরনাহার। তিনি বলেন, ‘সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিহত ব্যক্তিদের জন্য কত সাহায্য আসে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা আমরা পাইনি। আমার স্বামীর তো লাশটাও পাওয়া যায়নি। দিনের পর দিন একটু শাক, পানি দিয়ে ভাত খাই। সাগর থেকে কেউ দুই একটি মাছ দিলে তখন ছেলেদের মাছ-ভাত দিতে পারি।’

একই চিত্র সাগর থেকে ফিরে না আসা প্রায় সব জেলের পরিবারে।

আয়ের বিষয়ে কথা হয় স্বামী হারানো মরিয়ম বেগমের সঙ্গে। দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে চারজনের পরিবার তাঁর। মরিয়ম বলেন, স্বামী মো. তালেব সমুদ্র থেকে ফেরেননি বছর আটেক হলো। টেনেটুনে খরচ করলেও দিনে সংসারের খরচ তিন শ টাকা। জাল বুনে, পুকুরে মাছ ধরে আয় হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা। তিনি বলেন, ‘কীভাবে যে আমাদের দিন কাটে, তা শুধু আমরাই জানি। এখানে যে আমরা ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছি, ওপরওয়ালা মনে হয় তা দেখেন না।’

ভাষা-বগা গ্রামের যেসব জেলে পরিবার সরকারি সহায়তার আওতায় আসেনি, তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হবে বলে জানান কচুয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. তাছমিনা খাতুন। তিনি বলেন, মৎস্য অফিস ও সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন তাঁরা।

বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এএসএম রাসেল বলেন, গত এক বছরে কচুয়ার ৫টি পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে সাহায্য দেওয়া হয়েছে। সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘গ্রামটির অনেক পরিবারের পক্ষ থেকে জেলেরা মারা গেছেন বা নিখোঁজ রয়েছেন দাবি করা হলেও আইনগত কিছু জটিলতা রয়েছে। তারপরেও আমরা চেষ্টা করছি তাঁদের সহযোগিতা করার।’ জেলেদের নিরাপত্তায় এখন পর্যন্ত চার শ ট্রলারে ‘ভেসেল ট্র্যাকিং মনিটরিং সিস্টেম’ (ভিটিএমএস) বসানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

এএসএম রাসেল আরও বলেন, বাগেরহাট থেকে ১২ শ’র মতো ট্রলার সমুদ্রে যায়। জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই মাছ ধরেন। জালে যখন মাছ ধরা পড়তে শুরু করে, তখন জেলেরা থামতেই চান না। সাগর উত্তাল হয়ে উঠলেও নিরাপদ দূরত্বে না এসে তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন। বেশি দুর্ঘটনা ঘটে এই সময়টাতে। আবার ট্রলারগুলোতেও যথেষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখা হয় না।