দ্বন্দ্বের প্রভাব নির্বাচনে পড়ার আশঙ্কা

আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে বিরোধ চলছে।

আবদুল ওহাব, শাহিনুজ্জামান

এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, বালুমহাল দখলসহ নানা বিষয় নিয়ে পাবনার সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগে দুই পক্ষের বিরোধ প্রকট আকার ধারণ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে এ বিরোধ চলছে। শীর্ষ দুই নেতার এ বিরোধ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন তৃণমূলের নেতা–কর্মীরা।

এ বিরোধে সাধারণ সম্পাদককে দায়ী করে সভাপতি আবদুল ওহাব ও তাঁর সমর্থকেরা বলেন, বালুমহাল দখলসহ অবৈধ প্রভাব সৃষ্টির জন্যই সাধারণ সম্পাদক দলকে বিভক্ত করেছেন। এতে তৃণমূল নেতারা তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন।

সভাপতির দাবিকে ‘অশিক্ষিতের মতো কথা’ বলে উল্লেখ করেছেন সাধারণ সম্পাদক শাহিনুজ্জামান। তিনি দাবি করেন, এ বিরোধ নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা, অন্য কিছু নয়।

উপজেলা আওয়ামী লীগের অন্তত ১০ জন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের এ বিরোধ দীর্ঘদিনের। একসময় সম্পাদক শাহিনুজ্জামানের বাবা আবুল কাশেম উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তখন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বর্তমান সভাপতি আবদুল ওহাব। তখন থেকেই উপজেলায় সভাপতি ও সম্পাদকের বিরোধ শুরু। একজন ডানে গেলে অন্যজন বাঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। ২০১৬ সালে আবুল কাশেম মারা যান। এরপর ২০১৮ সালে আবদুল ওহাব সভাপতি ও শাহিনুজ্জামান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কিন্তু পুরোনো বিরোধ থেকেই যায়। সভাপতি তৃণমূল নেতাদের সমর্থন নিয়ে নিজের মতো দল গোছাতে শুরু করেন। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদকও একই কায়দায় দলের অন্য নেতাদের সমর্থন নিয়ে পৃথক বলয় তৈরি করেন। এতে বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নেয়।

দলের তৃণমূল নেতাদের দাবি, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পাবনা-২ (বেড়া-সুজানগর) আসনে একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। এর মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য খন্দকার আজিজুল হক, বর্তমান সংসদ সদস্য আহম্মেদ ফিরোজ কবির এবং কেন্দ্রী আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক কামরুজ্জামানসহ কয়েকজন প্রার্থী রয়েছেন। সভাপতি আবদুল ওহাব একসময় সাবেক সভাপতি খন্দকার আজিজুল হকের সমর্থক ছিলেন। বর্তমানে তৃণমূলে কামরুজ্জামানের অবস্থান শক্ত হওয়ায় তিনি তাঁকে সমর্থন দিচ্ছেন। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য আহম্মেদ ফিরোজ কবিরকে সমর্থন করেন। ফলে আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের বিরোধ আরও চরম আকার ধারণ করেছে।

সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনেও সভাপতি ও সম্পাদক পৃথক প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করেছেন। সভাপতি যে ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষ নিয়েছেন, সাধারণ সম্পাদক সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত বছরের ১৩ মার্চ সুজানগর পৌরসভার কর্মচারী আল আমিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ও দুই পক্ষ বিরোধে জড়িয়েছে। এ সময় সভাপতি অভিযোগ করেন, জমিসংক্রান্ত বিরোধে আল আমিন খুন হলেও সাধারণ সম্পাদক বিষয়টিকে রাজনীতিকরণ করেছিলেন। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের ২৬ জন পদধারী নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন। এতে দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের এলাকাছাড়া হতে হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে ২১ মার্চ সভাপতি নিজে সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে পাবনা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে একটি সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক মেয়র তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘উপজেলায় আওয়ামী লীগের বিরোধ জিইয়ে রাখার জন্য দলের কিছু কর্তাব্যক্তিরও অবদান রয়েছে। সংসদ সদস্য একজন সর্বজনীন ব্যক্তিত্ব হলেও তৃণমূলের সমর্থন হারিয়ে তিনি সাধারণ সম্পাদকের ওপর ভর করেছেন। আর তাঁর প্রভাবেই সাধারণ সম্পাদক প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। তিনি অন্য কাউকে মূল্যায়ন করছেন না।

সুজানগর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ফেরদৌস আলম বলেন, ‘সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ সময় যেকোনো নেতা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন করতেই পারে। তবে শেষ পর্যন্ত জননেত্রী শেখ হাসিনা যাঁকে মনোনয়ন দেবেন, তাঁর পক্ষেই সবাই থাকবেন। বিরোধও মিটে যাবে বলে প্রত্যাশা করি।’

জানতে চাইলে সভাপতি আবদুল ওহাব বলেন, ‘মূলত অবৈধ বালুমহাল দখল ও অনৈতিক প্রভাব সৃষ্টির জন্য সাধারণ সম্পাদক মরিয়া। তিনি দল নিয়ে কিছু ভাবেন না। তাই তৃণমূলের নেতা–কর্মীরাও তাঁকে ত্যাগ করেছেন। উপজেলার ৭ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাঁর সঙ্গে নেই, সাত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকের ১৪ জনের ১২ জন তাঁর বিপক্ষে। এরপরও তিনি সংসদ সদস্যের লোক বলে প্রভাবশালী ভূমিকায় রয়েছেন। এটা দলের জন্য বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।’

সাধারণ সম্পাদক শাহিনুজ্জামান বলেন, ‘আমার রক্তে আওয়ামী লীগ। আমার প্রতিটি কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগের জন্য। আওয়ামী লীগ যাঁরা করেন, তাঁদের সবার সঙ্গেই আমি আছি। কেউ অশিক্ষিতের মতো কিছু বললে কিছু করার নেই।’

এ বিষয়ে পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবির বলেন, ‘আমি কারও পক্ষেও না, বিপক্ষেও না। সবার পক্ষেই আছি। সভাপতি–সম্পাদকের বিরোধ দীর্ঘদিনের। অনেকবার বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হয়েছে।’