দিনাজপুরে ৮ সহস্রাধিক ডাকটিকিট নিয়ে প্রদর্শনী, দর্শনার্থীদের ভিড়
১৯৪৭ সালে বাংলাভাগের পর ভাষা প্রশ্নে পল্লিকবি জসীমউদ্দীনসহ কয়েকজন বলেছিলেন পাকিস্তানের ভাষা হবে বাংলা। এ বিষয়ে তাঁরা খবরের কাগজে বিবৃতিও দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। বায়ান্নর সেই আন্দোলন একাত্তরের স্বাধীনতাসংগ্রামেও প্রেরণা জুগিয়েছে। বাংলা ভাষা প্রাপ্তির স্বীকৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে জসীমউদ্দীন্সহ কয়েকজনকে নিয়ে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের ছবিসংবলিত ওই ডাকটিকিট দেখিয়ে এসব কথা বলছিলেন উদয় শংকর বিশ্বাস। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের শিক্ষক এবং বরেন্দ্র ফিলাটেলক সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও ডাকটিকিট সংগ্রাহক। দিনাজপুরে প্রথমবারের মতো স্মারক ডাকটিকিট প্রদর্শনী ও বিক্রয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আজ শুক্রবার সকালে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র মিলনায়তনে দিনব্যাপী এই প্রদর্শনী শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ডাক বিভাগ ও বরেন্দ্র ফিলাটেলিক সোসাইটি এই প্রদর্শনীর আয়োজন করে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন দিনাজপুরের ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল রশিদুল ইসলাম। প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এনামউল্যা, সহ–উপাচার্য শফিকুল ইসলাম সিকদার, ডাক অধিদপ্তরের পরিচালক (স্ট্যাম্পস) মামুনুর রশিদ, বরেন্দ্র ফিলাটেলিক সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক উদয় শংকর বিশ্বাস, রাজশাহীর অতিরিক্ত পোস্টমাস্টার জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রমুখ।
আজ সকালে গিয়ে দেখা যায়, ডাকটিকিট দেখতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের উপচে পড়া ভিড়। প্রায় আট সহস্রাধিক ডাকটিকিট, পোস্টকার্ড, স্যুভেনির, বিশেষ খাম, উদ্বোধনী খাম প্রদর্শন করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধ বিষয়াবলির পাশাপাশি বাংলাদেশের ফুল, পশুপাখি, মাছ, লোকসংস্কৃতিবিষয়ক বিভিন্ন উৎসব, পোশাক, অলিম্পিকসহ বিভিন্ন খেলাধুলা, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ, সমাজ সংস্কারে অবদান রাখা বিশেষভাবে স্বীকৃত ব্যক্তির ছবিসংবলিত ডাকটিকিট রয়েছে। বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে উদ্বোধনী খাম, বিশেষ খাম, বিভিন্ন স্মারক ডাকটিকিট ও পোস্টকার্ড। কেউ ছবি তোলায় ব্যস্ত, কেউ আবার বিভিন্ন ডাকটিকিট বিষয়ে জানতে আয়োজকদের নানা প্রশ্ন করছেন।
আয়োজকদের একজন ডাক বিভাগের নকশাকারক সুমন্ত কুমার জানান, ২০২১ সালে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে বরেন্দ্র ফিলাটেলিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন কয়েকজন ডাকটিকিট সংগ্রাহক। বর্তমানে সংগঠনের সদস্য সংখ্যা অর্ধশত। যাঁদের প্রত্যেকের সংগ্রহে ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ডাকটিকিট রয়েছে। এরই মধ্যে দেশের পাঁচটি বিভাগীয় শহরে এ ধরনের প্রদর্শনী করা হয়েছে।
সুমন্ত কুমার বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ডাকটিকিট সংগ্রহের নির্মল আনন্দকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে আমরা কাজ করছি। বর্তমানে অধিকাংশ শিশু-কিশোর-যুবক মুঠোফোনে আসক্ত হয়ে পড়েছে, নেশাগ্রস্ত হয়ে জীবনকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ডাকটিকিট সংগ্রহের মাধ্যমে নির্মল আনন্দ ফিরিয়ে আনতে সংগ্রহকাজকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে কাজ করছে বরেন্দ্র ফিলাটেলিক সোসাইটি।’
প্রদর্শনীতে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থী নাঈম ইসলাম বলেন, ‘খুবই ভালো লাগছে। বাংলাদেশের প্রথম প্রকাশিত বিমান মল্লিকের নকশা করা আটটি ডাকটিকিটও দেখলাম। জীবনে প্রথমবার এ রকম প্রদর্শনীতে আসছি। একটি ডাকটিকিটের মাধ্যমে একটি দেশকে চেনা যায়। সেই দেশের ইতিহাস–ঐতিহ্যকে বোঝা যায়। কত রকমের যে ডাকটিকিট দেখলাম। এ বিষয়ে তেমন কোনো ধারণাই ছিল না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসুজ্জোহা বলেন, ‘ডাকটিকিটগুলো কালের স্বাক্ষী। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে চিঠি, পোস্টকার্ড, ডাকঘর, ডাকপিয়ন এসবের আবেদন কমে গেছে। আগামী প্রজন্মকে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ে জানাতে এ ধরনের আয়োজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ডাকটিকিট প্রকাশের নেপথ্যে এক টুকরো কাগজে একটি ঐতিহাসিক সত্য আছে। প্রদর্শনীটা ঘুরে দেখে যেন শৈশবে ফিরে গেলাম।’
প্রদর্শনীর বিষয়ে বরেন্দ্র ফিলাটেলিক সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক উদয় শংকর বিশ্বাস বলেন, ডাকটিকিট সংগ্রহ করা একটি মজার শখ এবং নেশাও বটে। আপাতদৃষ্টে একটি ডাকটিকিট একটি কাগজের টুকরা। কিন্তু একজন শিক্ষার্থী যখন ওই কাগজের টুকরাটি হাতে নেবে, তখন তাঁর মনে নানা প্রশ্ন জাগবে এবং সে জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করার প্রয়াস পাবেন। একটি দেশের সংস্কৃতি উপস্থাপিত হয় ওই দেশের ডাকটিকিটে। বাংলাদেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে জনমত যাচাইয়েও ডাকটিকিটের ভূমিকা ছিল। সুতরাং আমাদের সুমহান ঐতিহ্যেকে আগামী প্রজন্মকে জানাতে ডাকটিকিট প্রদর্শনীর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।