‘জঙ্গল বন্ধের মধ্যে আইছে ঈদ, দুই বেলা ভাতই জোটে না ঈদের আনন্দ করব ক্যামনে’

সুন্দরবনে প্রবেশ বন্ধ থাকায় সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোর আয়ের পথ বন্ধ। ঈদে পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো নিয়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ বনজীবীদের কপালে। শুক্রবার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন মঠবাড়ি গ্রামেছবি: প্রথম আলো

‘বন্ধের জন্যি জঙ্গলে মাছ ধরতি যাতি পারিনে। সরকারের থেইকে সাহায্য-সহযোগিতাও পাইনি। আয়রোজগার নেই, হাত খালি। পরিবার নিয়ে খাইয়ে না খাইয়ে আছি। এখন আবার বন্ধের মধ্যে আইছে ঈদ, দুই বেলা ভাতই জোটে না ঈদের আনন্দ করব ক্যামনে। ছোট ছাওয়াল–মাইয়ে নতুন কাপড়ের জন্যি কান্দে। খুব বিপদের মধ্যে আছি।’

শুক্রবার সকালে খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন মঠবাড়ি এলাকার জেলেপল্লিতে এ কথাগুলো বলছিলেন বনজীবী জেলে ইমদাদুল গাজী। ১ জুন থেকে সুন্দরবনে প্রবেশে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে। এই সময়ে সরকারি কোনো সহায়তা না পাওয়ায় ঈদের আগমুহূর্তে পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।

শুধু ইমদাদুল গাজী নন, সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল অধিকাংশ বনজীবী পরিবারের অবস্থাই এখন এমন। সংসারের চাকা ঘুরছে না। ধারদেনা করেই চলছে দিন। ঈদের সময়ও স্বস্তির মুখ দেখেনি তারা।

মঠবাড়ি গ্রামের জেলে মজিবর গাইন বলেন, ‘সুন্দরবন বন্ধ থাকায় সাতজনের পরিবার নিয়ে ধারদেনা করে চলছি। আজ সকালেও ৫০০ টাকা ধার করে চাল কিনেছি। বাচ্চাদের একটা জামাকাপড় কিনে দেব, ঈদের দিনে একটু ভালোমন্দ খাওয়াব, এই সামর্থ্য আমার নেই। তবে এই অবস্থা শুধু আমার একার নয়, সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল বেশির ভাগ মানুষের।’

বন বিভাগের তথ্য বলছে, সুন্দরবনের সমন্বিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (আইআরএমপি) অনুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দুই মাস মাছ আহরণ নিষিদ্ধ ছিল। ২০২২ সালে তা ১ জুন থেকে বাড়িয়ে তিন মাস করা হয়। এখন ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ থাকে, সেই সঙ্গে পর্যটক ও বনজীবীদের প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা থাকে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সমুদ্রে মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তখন প্রত্যেক জেলেকে সরকারিভাবে ৮০ কেজি চাল দেওয়া হয়। কিন্তু সুন্দরবনের জেলেদের জন্য তেমন সহায়তা নেই। ফলে নিষেধাজ্ঞার সময়টাতে মানবেতর অবস্থায় পড়েন তাঁরা।

কয়রার মহেশ্বরীপুর এলাকার বনজীবী জেলে আবদুল আহাদ বলেন, ‘সুন্দরবনে পাস বন্ধ। ডাঙায়ও কাজ নেই। বেকার বসে আছি। সংসার চলছে ধারদেনায়, খুব কষ্টে। ঈদে আমাগে কোনো উপায় নেই। চিনি-সেমাই যতটুকু হোক, গোশত তো চোখে দেখব না। আমাগের কাছে ঈদের দিন আর অন্যদিন একই সমান।’

কয়রা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় জানায়, উপজেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১৩ হাজার ৮৫। তবে স্থানীয় বনজীবীরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। ভৌগোলিক কারণে কয়রার পাঁচটি ইউনিয়নের অধিকাংশ পরিবারই বননির্ভর। কয়রায় অন্তত ৫০ হাজার বনজীবী পরিবারের বাস, যারা নদী ও খালে মাছ ও কাঁকড়া ধরেই জীবন চালায়।

সুন্দরবনে প্রবেশ বন্ধ থাকায় লোকালয়ের পাশের নদীতে নৌকায় বসে চিংড়ির রেণু আহরণের চেষ্টা করছেন কয়েকজন। শুক্রবার কয়রা উপজেলার কাটকাটা গ্রামসংলগ্ন শাকবাড়িয়া নদীতে
ছবি: প্রথম আলো

শুক্রবার সকালে কয়রা উপজেলার সুন্দরবনঘেঁষা তেঁতুলতলারচর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, গাদাগাদি করে তৈরি বনজীবীদের সারি সারি ঘর। কারও টিন, কারও গোলপাতা, কারও খড়ের জীর্ণশীর্ণ ঘর। পাশেই নদীর ওপর বানানো ঝুলন্ত শৌচাগার। ঘরগুলোর পাশেই আছড়ে পড়ছে নদীর ঢেউ। নদীর ওপারে সুন্দরবন। নদীর তীরে সারি সারি নৌকা বাঁধা।

নদীর পাশের চরের জমিতে এক কক্ষের টিনের দোচালা ঘর আসলাম মোড়লের। সংসার চালাতে পাড়ি দিতে হয় সুন্দরবনের ওপারে। আসলামের ভরসা একটি ছোট ডিঙিনৌকা। আসলাম মোড়ল বলেন, ‘আমরা বাপ-দাদার আমল থেকে বন করে খাই। পাস পারমিট বন্ধ করে দেওয়ায় এখন ঘরে ভাতই জোডে না। ঈদের কেনাকাটা করব ক্যামনে।’

আসলামের কথা থামিয়ে তাঁর স্ত্রী শরীফা বেগম বলেন, ‘শুনেছিলাম সুন্দরবন বন্ধের সময় আমাগের চাল দেওয়া হবে। তা যে কবে পাব, তাও ঠিকঠাক জানিনে। কেউ ধারও দিতে চাচ্ছে না।’

মহেশ্বরীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারী বলেন, ‘আমার এলাকায় প্রায় দুই হাজার পরিবার আছে, যারা সরাসরি সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। বনে ঢোকা বন্ধ থাকায় এসব পরিবারের দিন কাটছে কষ্টে। যারা ভিজিডি ও ভিজিএফ পায়, তারা কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও অনেকেই এ সুবিধা পায় না। সেসব পরিবার চলছে ধারদেনায়।’

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি বন্ধ মৌসুমের এই তিন মাসে বনজীবীদের জন্য বিকল্প খাদ্যসহায়তা দেওয়ার। ইতিমধ্যে মৎস্য মন্ত্রণালয় থেকে বনজীবীদের তালিকাও নেওয়া হয়েছে। তবে এখনো মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন হয়নি। আমাদের কাছে সরকারি কোনো বরাদ্দ না থাকায় ঈদে বনজীবীদের কোনো সহযোগিতা করা যায়নি।’